স্বাগতা দাশগুপ্তের (“‘দলিত সাহিত্য’ ও কিছু যুক্তিবুদ্ধি”, ৯-৫) প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করলাম। ২০২০ সালে মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি গঠন করে এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। অনেকের প্রশ্ন ছিল, সাহিত্যের আবার দলিত-অদলিত হয় নাকি? দলিত সাহিত্যকে আলাদা ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? না কি শাসক দলের উদ্দেশ্য দলিত ভোট ব্যাঙ্ক তুষ্ট করার? তর্কপ্রিয় বাঙালি কখনও কখনও সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করতে একটুও লজ্জাবোধ করে না। উচ্চবর্ণীয় সাহিত্যিকরা অনেকে দলিত সাহিত্য কথাটায় নাক সিঁটকোন। দলিত সাহিত্য বিষয়টা শাক্ত, বৈষ্ণব, মুসলমান, নারীবাদী, মার্ক্সীয়, হাংরি সাহিত্যের মতো সাহিত্যেরই একটি ভাগ, সেটা পশ্চিমবঙ্গের অনেক সাহিত্যিক মেনে নিতে পারছেন না। অনেকে এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন ‘দলিত সাহিত্য’ কথাটি তাঁরা বাংলায় প্রথম শুনছেন। দলিত সাহিত্য শুধুমাত্র বাংলাতেই নয়, সারা ভারতে বিদ্যমান। এই ধারাকে স্বীকৃতি দিয়েছে মরাঠি, গুজরাতি, পঞ্জাবি, কন্নড়, হিন্দি, তামিল, মালয়ালম প্রভৃতি ভাষা। দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি ভারতে অনেক রাজ্যেই আছে। যেমন, মহারাষ্ট্র ও গুজরাত। এই সাহিত্য প্রধানত জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতা থেকে উদ্ভূত। এর জনক বলা হয় মহারাষ্ট্রকে। পঞ্চাশের দশক থেকেই ধীরে ধীরে এই সাহিত্য মহারাষ্ট্রে গুরুত্ব সহকারে চর্চিত হতে থাকে।
দুঃখের বিষয়, আম্বেডকরের অবদান পশ্চিমবঙ্গের কম লোকই জানে। এই ব্যর্থতা অনেক দিনের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “স্ত্রীলোকের লেখা এটুকু বলতে পারি, মেয়ের কথা মেয়েতে যেমন করিয়া লিখিয়াছে এমন কোনো পুরুষ গ্রন্থকার লিখিতে পারে না।” একই ভাবে, দলিতের কথা দলিত যেমন করে লিখতে পারেন, উচ্চবর্ণীয় লেখক লিখতে পারেন না। অতএব দলিতের জন্য, দলিতের কথা, দলিতের দ্বারা লেখা যে সাহিত্য, তা-ই দলিত সাহিত্য। অ্যাকাডেমি গঠনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দলিত সম্প্রদায়গুলির সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
বিপদতারণ ধীবর, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
স্বাতন্ত্র্যের পথ
স্বাগতা দাশগুপ্তের প্রবন্ধ বিষয়ে দু’একটি কথা বলতে চাই। বিগত এক দশক ধরে ভারতের অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্যের ন্যায় পশ্চিমবঙ্গেও দলিত আন্দোলন, দলিত সংগঠন, দলিত লেখক, দলিত সাহিত্য— সমস্ত বিষয় মিলেমিশে একটি নতুন ভাষ্য রূপে পরিচিত হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই পরিচিতিকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি গঠনের ঘোষণা। ১৯৮৭ সালের ২৮-২৯ এপ্রিল উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরে প্রথম বঙ্গীয় দলিত সাহিত্য সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয় ‘বঙ্গীয় দলিত লেখক পরিষদ’। নকুল মল্লিকের সম্পাদনায় পরিষদের মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দলিত কণ্ঠ নামের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। পরবর্তী কালে কলকাতার বিধাননগরে ১৯৯২ সালে অধ্যাপক জগদ্বন্ধু বিশ্বাসের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’। সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন যথাক্রমে অমর বিশ্বাস ও ঊষারঞ্জন মজুমদার। একই বছরের ৫-৬ ডিসেম্বর নদিয়া জেলার বগুলার কাছে ভায়না গ্রামে ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’-র প্রথম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার মুখপত্রের নাম চতুর্থ দুনিয়া। বিগত তিন দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় রাজ্য সম্মেলন ও জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে দলিত সাহিত্য চর্চার প্রচার-প্রসার চলেছে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক যতীন বালা বর্তমান দলিত সাহিত্যের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। ১) দলিত জীবনের পীড়নের অভিজ্ঞতা ২) বিদ্রোহ ৩) অস্বীকৃতি ৪) জনতত্ত্বের আবিষ্কার এবং ৫) নবনির্মাণ।
দলিত আন্দোলন কাকে বলে, এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষকের বিভিন্ন সংজ্ঞা পাওয়া যায়। নন্দদুলাল মোহন্ত প্রদত্ত সংজ্ঞাটি হল, “ভারতবর্ষে বর্ণব্যবস্থা-বিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক সূত্রপাত ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনে সাংগঠনিক প্রচার পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে রাখা সমাজের মানুষের সার্বিক পুনরুজ্জীবন আন্দোলন রূপে আত্মপ্রকাশ করে, তখন তাকে দলিত আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়।”
দলিত সাহিত্যের লক্ষ্য কী? তুষ্টি ভট্টাচার্য বলেছেন, “দলিত সাহিত্যে কাল্পনিক গল্পগাথার চেয়ে বাস্তবের অভিজ্ঞতা, আত্মস্মৃতি বা আত্মচরিতই সবচেয়ে জোরের জায়গা। প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধ বা অলীক ধারণার (মিথ) বিরোধিতা, অস্বীকার এবং তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে দলিত জনগোষ্ঠীগুলির ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাচীন সংস্কৃতির উৎস অনুসন্ধান করে বৈষম্যহীন মানবিক মূল্যবোধ-নির্মিত সমাজ গঠনই দলিত সাহিত্যের অন্তর্নিহিত প্রত্যয়।”
এখানে দু’টি আশঙ্কার কথা বলি। প্রথমটি, পশ্চিমবঙ্গের দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই শাসক দলের একান্ত অনুগত। ফলে তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে মুখ খুলবেন, এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট। দ্বিতীয় আশঙ্কা, দলিত সাহিত্যিকরা কি শুধুমাত্র দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারেই ভূষিত হবেন? তাঁরা কি পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য অকাদেমি সম্মানের জন্য বিবেচিত হবেন না? এই ভাবে কি একটা আমরা-ওরা বিভাজনের সূত্রপাত ঘটতে চলেছে?
চণ্ডাল বিশ্বাস, নেউলিয়া, নদিয়া
উপেক্ষিত বাংলা
অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হিন্দি শীর্ষে উঠছে যে পথে’ (২৩-৪) রচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠির অবতারণা। হাওড়া থেকে টাটানগর ট্রেনে আসতে মাঝে চাকুলিয়া স্টেশন পড়ে। সম্প্রতি সৌন্দর্যায়নের পর কেবল ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় স্টেশনের নাম লেখা হয়েছে। যদিও স্টেশনের নাম লেখার ব্যাপারে স্থানীয় ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়াই নিয়ম। চাকুলিয়া পূর্ব সিংভূম জেলায় পড়ে, যা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত। কিন্তু এই অঞ্চলে বাংলাভাষীর সংখ্যা যথেষ্ট। একই ভাবে টাটা-বাদামপাহাড় রেল রুট অন্তর্গত হলুদপুকুর স্টেশনের নামফলক থেকে বাংলা বাদ পড়েছে। জামশেদপুরের একটি সামাজিক সংস্থা এই প্রসঙ্গে স্থানীয় বিধায়ক সমীর মহান্তির মাধ্যমে চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে অনুরোধ করেছে, যেন তিনি রেলমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করে দু’টি স্টেশনেরই নামের ফলকে বাংলা ভাষাকে পুনরায় স্থান দেন।
২০১১ সালে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা সরকারের তরফ থেকে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেয়। তা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত প্রায় কিছুই করা হয়নি। ২০০১-এর জনগণনা রিপোর্টের তথ্য বলছে, রাজ্যে মোট ৮৭টি ভাষার প্রচলন থাকা সত্ত্বেও বাংলাভাষীর সংখ্যা এখানে সবচেয়ে বেশি। তবু ঝাড়খণ্ডে আজ বাংলা ভাষা চরম দুরবস্থায়। এর সূত্রপাত হয় ৩০ বছর আগে, যখন তৎকালীন বিহার সরকার রাজ্যে বাংলা ভাষার প্রাথমিক, মধ্য ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলিকে ক্রমাগত হিন্দি বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে থাকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের বাংলাভাষীদের পক্ষ থেকে রাজ্যপালকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়, যাতে রেলওয়ে স্টেশন ও বাস স্ট্যান্ডে বাংলায় ঘোষণা, দূরদর্শন ও রেডিয়োতে বাংলা অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য, এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়। ঝাড়খণ্ডে প্রায় গত দুই দশক ধরে চলমান এই আন্দোলনের প্রতি বাংলা সংবাদপত্রগুলির তরফ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy