লকডাউনের বাধ্যবাধকতা নেই। তবু সুনসান সুইডেনের সমুদ্র সৈকত।
উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের ছোট দেশ সুইডেন। জনসংখ্যার নিরিখে ইউরোপে ১৩ নম্বর— এক কোটির সামান্য বেশি। কর্মসূত্রে এই সুইডেনের দক্ষিণের সীমান্তবর্তী জেলা স্কনে-তে আমাদের বর্তমান নিবাস। অপর পারে ডেনমার্ক। গোটা জেলায় ১৩ লক্ষ মানুষের বাস। আমাদের শহর হেলসিংবর্গে মাত্র ১ লক্ষ। তাতেই এই করোনা আক্রান্ত সময়ে ত্রাহিমাং পরিস্থিতি। সরকারি নির্দেশানুসারে করোনা পরীক্ষা সীমিত কেবলমাত্র গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে। নয়তো করোনার বাকি সব লক্ষণ থাকলেও পরীক্ষা করা হচ্ছে না। কেবল গৃহবন্দি থাকার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। শুধু এই জেলাতেই ৭০০ জনের বেশি মানুষ আক্রান্ত। মৃতের সংখ্যা ৭০ জনের কাছাকাছি। রাজধানী স্টকহোমের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
সুইডেন সরকারের সিদ্ধান্ত এমতাবস্থায় রীতিমতো বিপ্লবী। দেশে কোনও লকডাউন নেই। অদূর ভবিষ্যতে লকডাউনের সম্ভাবনাও নেই বিশেষ। মার্চের মাঝামাঝি ৫০০ জনের বেশি জমায়েত নিষেধ ছিল। এপ্রিল থেকে সেটা কমিয়ে ৫০ করা হয়েছে। শিশুশিক্ষা এখানে জরুরি পরিষেবা। তাই বাচ্চাদের স্কুল ও ডে-কেয়ার খোলা। অন্যতম কারণ যে, বাচ্চারা বাড়ি থাকলে স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত বাবা-মায়েরা কাজে বেরোতে পারবেন না অথবা বয়স্ক দাদু-দিদার জিম্মায় রাখবে। যেহেতু বয়স্কদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি, তাই তাকে প্রতিহত করতেই এই ব্যবস্থা। শুধু ১৫ বছরের ওপরের ছাত্র-ছাত্রীদের হাই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। অধিকাংশ অফিস-কাছারি অবশ্য বন্ধ। কিন্তু হোটেল-রেস্তরাঁ বা দোকান-বাজার সবই স্বাভাবিক। বাস ট্রেন চলছে। ডেনমার্ক সীমানা বন্ধ রেখেছে বলে শুধুমাত্র অন্য দেশে যাওয়ার ট্রেন বন্ধ। সরকারি নির্দেশিকায় কোথাও সামাজিক দূরত্বের উল্লেখ নেই। শুধু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। বয়স্কদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে। আর জোর দেওয়া হয়েছে নিজেদের বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। মাঝে ইস্টার-এর ছুটি ছিল। তাতে কোনও নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও ৯০ শতাংশ কম মানুষ বেরিয়েছেন। পার্কে কিছু বার বি কিউ হয়েছে অবশ্য। আজকের দুনিয়ায় এ হেন গণতন্ত্র সত্যি বিরল! সে কারণে শুরুতে এই সরকারি নীতির পেছনে যথেষ্ট জন সমর্থন ছিল। অধিকাংশ দেশীয় বৈজ্ঞানিকও সমর্থন জানিয়েছিলেন খানিকটা হু-এর বিরুদ্ধমতে গিয়েই।
কিন্তু এই আপাতস্বাভাবিক পরিস্থিতিই ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী অন্যান্য নর্ডিক(ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল) দেশগুলির তুলনায়। সুইডেনের মোট জনসংখ্যা প্রতিবেশী দেশ— যেমন ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের তুলনায় ঠিক দ্বিগুণ। সুইডেন ছাড়া বাকি তিনটি দেশ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মতোই মার্চের মাঝামাঝি থেকে লকডাউন শুরু করে দিয়েছে। চারটি দেশেই মোট জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ বৃদ্ধ বা অতিবৃদ্ধ। অথচ প্রতি দশ লাখে মৃত্যুহার এখানে ডেনমার্কের তুলনায় প্রায় ৪ গুণ আর ফিনল্যান্ড ও নরওয়ের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি।
আগেই বলেছি, এখানে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে নিতান্তই সীমিত পরিসরে। তাই আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে তুলনা করলাম না। সেটাও দৃষ্টিকটু ভাবে বেশি। প্রতি দশ লাখে করোনা পরীক্ষার হার বাকি তিনটি দেশের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। নানা সংবাদ আসছে আমাদের এই জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে— শহরতলীর একমাত্র হাসপাতালে বিশেষ একটি বিভাগের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংক্রান্ত নীতির জন্য বিভাগটির নাম প্রকাশ করা হয়নি, কোন কোন রোগী সেই বিভাগে এই কদিন গিয়েছেন, সে সম্পর্কেও কোনও তথ্য প্রকাশ হয়নি। কখনও আবার শুনছি, কোনও এক স্কুলে শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে করোনাতে। লকডাউন না থাকার জন্যে উপসর্গহীন কেস যে কত, সে সম্পর্কে কারও সম্যক ধারণা নেই। শুধু স্টকহোমের সংখ্যাই ৬০-৭০ হাজার হতে পারে। এই অবস্থায় দেশের জনা বিশেক বৈজ্ঞানিক অবিলম্বে সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। কিন্তু সরকার নিজ নীতিতে অচল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও সন্দিহান এই নীতির কার্যকারিতায়। সমালোচনায় সরব হয়েছেন অনেকেই। দেশীয় অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেওয়াটাই এই নীতির প্রাথমিক কারণ ছিল। অথচ এখন বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাসে আন্দাজ করা হচ্ছে যে, চারটি দেশেই আগামী দিনে জিডিপির পতন হবে। কর্মহীনতা ২ থেকে ৩ শতাংশ বাড়বে গত কয়েক বছরের তুলনায়। বিশ্বজোড়া টালমাটাল অবস্থায় তাই অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখা খানিক অলীক কল্পনাই মনে হচ্ছে সংখ্যাগুরু জনতার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব নেই। কিন্তু স্যানিটাইজার, ডেটল আর জ্বরের ওষুধের আকাল শুরু হয়ে গিয়েছে।
তাও আমরা ভরসা রাখছি। আমরা তো তা-ও ভাগ্যবান। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার অবসর আছে। ভাবি আমার নিজের দেশের কথা, যেখানে অধিকাংশ মানুষ কী ভীষণ অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। সত্যি তো, এই রোগ এবং এই রোগজনিত পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। কেউই জানি না নিশ্চিত পথ কোনটা। সব দেশ নিজের মত করে লড়াই করছে। নিরাময় অনতিদূরে যে নয়, সে একপ্রকার মেনে নিয়েছি। সুইডেন সরকার বলছে যে, অনন্ত লকডাউন সমাধান হতে পারে না, লকডাউন পরবর্তী পরিস্থিতি কী ভাবে সামাল দেওয়া যাবে, সেও এক আন্দাজ মাত্র। তাই এই নীতি, যেখানে খানিক স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হচ্ছে জনসাধারণকে কিছু নিয়ম কানুন সমেত, সুদূরপ্রসারী ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি সময় ধরে চালানো যাবে। সরকার পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থার প্রত্যাবর্তনের আশা করছে না এ বছর। আশা কেবল স্থিতিশীল অবস্থার। যদি আরও বড় রকমের দুর্ঘটনা হয়, সে ক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আশা করা হচ্ছে, তার আগেই বড় সংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা প্রতিরোধের শক্তি তৈরি হয়ে যাবে। আশা করা হচ্ছে, করোনা নতুন কোনও ভয়ঙ্করতর রূপ নেবে না। বছর ঘোরার আগে আসবে সঠিক চিকিৎসার ওষুধ। আসবে পরীক্ষিত ভ্যাকসিন। তাই ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ শুভবোধের ওপরেই থাকুক ভরসা। আজকের এই অবিশ্বাসী পৃথিবীতে তাই বা কম কি? গৌতমও তো আনন্দকে শেষে বলেছিলেন, ‘‘আত্মদীপো ভব, আত্মশরণ ভব, অনন্যশরণ ভব।’’ ভবিষ্যৎই নির্ণয় করুক সুইডেনের এই অনন্য পথটাই সঠিক কি না!
তমালিকা চক্রবর্তী
হেলসিংবর্গ, স্কনে
সুইডেন
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy