শীত চলে গিয়ে বসন্ত এসেছে আমেরিকায়। কিন্তু তা উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থায় নেই কেউ। মার্কিন সমাজ সরকারের জোরাজুরি পছন্দ করে না, তাই ভারতের মতো লকডাউন কার্যকর করা যায়নি এখানে। তবে নিজের দায়িত্বে বাডি়তে থাকার নীতি মনে চলছেন সকলে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বেরনোর প্রয়োজন নেই। দোকান-বাজার গেলেও দ্রুত কেনাকাটা সেরে ফিরে আসেন সকলে। নিউইয়র্কের পর ম্যাসাচুসেটস এখন মহামারির অন্যতম ভরকেন্দ্র। এখানে রোজই করোনা আক্রন্তের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। আগামী বেশ কিছু দিন এমন চলবে বলে জানা গিয়েছে। তাই সতর্ক থাকতে বলেছে প্রশাসন। সুপারমার্কেট খোলা থাকলেও যেতে বারণ করা হয়েছে।
বস্টনের একটি কলেজে পড়াই আমি। জানুয়ারির মাঝামাঝি কলকাতা থেকে ফিরেছি। দু’মাসের মধ্যে জীবনটা এ ভাবে পাল্টে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। এর আগে ৯/১১-এর সময় একবারই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছিলাম। কিন্তু তখন অদৃশ্য এক প্রতিপক্ষকে নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হলেও, সেই অদৃশ্যতা ছিল অনেকটাই প্রতীকী। তাছাড়া সে বার ব্যক্তিগত ভাবে আমার বিপদের কোনও আশঙ্কা ছিল না। তাই করোনার প্রকোপ ৯/১১-এর চেয়েও অনেক বেশি দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গৃহবন্দি থাকতে জীবন সম্পর্কে আরও বেশি করে বুঝতে শিখেছি। যেমন, আমাদের জীবনযাত্রার গঠন কতটা কৃত্রিন। ঘড়ি নয়, প্রতিদিনের কর্মসূচিই আমাদের দিন-তারিখ ইত্যাদি খেয়াল রাখতে সাহায্য করে। ঘড়ি তো এখনও চলছে, কিন্তু তবুও দিন, তারিখ প্রায়ই দেখে নিতে হচ্ছে। কলেজের সব কাজই এখন অনলাইনে। যে ক’দিন কাজ থাকে সেই দিনগুলি খেয়াল থাকে। কিন্তু বাকি দিনগুলির হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেন কত দূরে ফেলে এসেছি স্বাভাবিক জীবনকে। অতিপরিচিত জায়গাগুলিকেও এখন কেমন অচেনা, অস্বস্তিকর লাগছে।
আরও পড়ুন: আইসোলেশনে ইমরান খান, লালারসের নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে
আরও পড়ুন: ‘পালঘরের ঘটনায় ধৃত ১০১ জনের মধ্যে কোনও মুসলিম নেই’, জানালেন মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
কুড়ি বছরের ওপর এই শহরে আমার বাসয় এই দেশে প্রায় বত্রিশ বছর। বস্টন আমার কাছে কলকাতার মতোই। কিন্তু মাস্ক পরে রাস্তায় বেরোলে সবকিছু কেমন অচেনা লাগছে। অসবস্তি হচ্ছে, কোথাও যেন একটা অশুভ শক্তি ওৎপেতে রয়েছে। নিজের অজান্তেই আশেপাশের লোকজনকে মেপে নিচ্ছি। দেখে নিচ্ছি, তাঁদের কাউকে দেখে অসুস্থ লাগছে কি না। আরও একটা বিষয় বার বার মাথায় আসছে, মানুষের উন্নতি, দম্ভ, বৈভবের গর্ব, সভ্যতার ঔদ্ধত্য, প্রকৃতিকে বশে আনার বড়াই—সবটাই কী পরিমাণ ভঙ্গুর এবং হাস্যকর। পরাক্রমশালী সব দেশকে, পুঁজিবাদকে মাত্র কয়েক দিনে নতজানু করে দিল প্রকৃতি। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বিজ্ঞানীরাও যার শেষ দেখতে পাচ্ছেন না।
এর পর স্বাভাবিক জীবন যদি ফিরেও আসে, তাতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যাবেই। দেশে থাকা কাছের মানুষগুলির জন্য গক্ষীর দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আতঙ্কে রয়েছি, না জানি পরের বার গিয়ে কাকে দেখব আর কাকে দেখতে পাব না। আমার স্ত্রী এখনও কলকাতায় আটকে রয়েছে। কবে ফিরতে পারবে ঠিক নেই। পরের সেমেস্টারে কলেজ খুলবে নাকি অনলাইনে পড়িয়ে যেতে হবে, তা-ও জানা নেই। তবু এই উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও ইতিবাচক কিছু পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিছু শিক্ষা, প্রকিতির অপার শক্তির প্রতি সম্ভ্রম, যে মানুষগুলির রুজি-রোজগার লাটে উঠেছে, তাঁদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তার স্বীকৃতি এবং যে সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাণ হাতে নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, আমাদের পেট ভরানোর জন্য যাঁরা সুপারমার্কেট খুলে রাখছেন, তাঁদের অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইছি। এই মারণ ভাইরাসের কবল থেকে বেঁচে বেরোতে পারলে এইটুকু উপলব্ধিই বা কম কী?
সুনন্দকুমার সান্যাল
বস্টন, আমেরিকা
( অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy