Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Raj Kapoor

সম্পাদক সমীপেষু: শতবর্ষে রাজ কপূর

ছবির গল্প নিয়ে লেখকদ্বয় খোয়াজা আহমেদ আব্বাস ও ভি পি সাঠে প্রথমেই গিয়েছিলেন রাজ কপূরের কাছে। শর্ত ছিল— পৃথ্বীরাজ কপূরকেও কোনও ভাবে রাজি করাতে হবে।

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:২৩
Share: Save:

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘দিনবদলের স্বপ্নের ছবি’ (১৫-১২)-র সঙ্গে আরও কিছু ঘটনা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। রাজ কপূরের আওয়ারা ছবির নেপথ্য কাহিনি ছিল চমকপ্রদ। এ ছবির গল্প নিয়ে লেখকদ্বয় খোয়াজা আহমেদ আব্বাস ও ভি পি সাঠে প্রথমেই গিয়েছিলেন রাজ কপূরের কাছে। শর্ত ছিল— পৃথ্বীরাজ কপূরকেও কোনও ভাবে রাজি করাতে হবে। পরিচালনা করতে বলা হবে অবশ্য রাজ কপূরকে। শুরুতেই রাজের আশঙ্কা ছিল, বাবা রাজি হবেন না। লেখকদ্বয় পৃথ্বীরাজকে গল্প শোনালেন। শুনে খুব খুশি হয়ে তাঁদের জানিয়ে দিলেন, তিনি ছবিটা করবেন। প্রশ্ন করলেন— পরিচালক কে? আর নায়কের নাম কি? যখন শুনলেন দু’টিই তাঁর পুত্র রাজ, বলে ওঠেন— “করেছ কী হে? ও তো কিছুই পারে না! এত ভাল একটা গল্প, চিত্রনাট্য, ও তো ডোবাবে!” সঙ্গে পরামর্শও দেন— “নষ্ট কোরো না এত ভাল ছবি। যাও অন্য কোনও পরিচালক খোঁজো।” শেষে বহু কষ্টে পৃথ্বীরাজকে রাজি করানো হয়েছিল। বাকিটা ইতিহাস!

স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট অ্যান্ড্রুজ়-এর এর সেন্টার ফর ফিল্ম স্টাডিজ়-এর অধ্যাপক দিনা আয়োর্ডানোভার মতে, দুনিয়ার যত দেশে, যে বিপুল ভাবে আওয়ারা সমাদৃত হয়েছে, ১৯৫০-এর দশকের তেমন আর কোনও ছবি বিষয়ে তা বলা কঠিন। চলচ্চিত্র গবেষক আলেকজ়ান্ডার লিপকোভ তাঁর গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন— ঠিক সেই সময়ে স্তালিনের ভয়ঙ্কর স্বৈরতন্ত্র থেকে খানিকটা মুক্তি পেতে শুরু করেছে নিকিতা ক্রুশ্চেভের জমানার রুশ জনগণ। স্তালিনের কড়া তাত্ত্বিক চাবুকে তৈরি ‘বাস্তববাদী’ ছবি দেখে তারা ক্লান্ত, তারই মাঝখানে রাজ কপূরের আওয়ারা ছিল তাদের কাছে তাজা বাতাস। রাজ কপূরের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেম অটুট ছিল আমৃত্যু।

প্রবন্ধকার লিখেছেন— নেহরুর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের অংশীদার ছিলেন রাজ কপূরও। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রায় শেষ পর্বে, ১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল শ্রী ৪২০। দেশ গঠনের কাজ চলছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান সেই কর্মযজ্ঞে শামিল। তেমনই একটা সময়ে তৈরি ছবিতে জীবন গড়ার আশায় শহরে আসে রাজ। মহানগরে পা রেখে সে দেখল, সেখানে আছে শিক্ষিকা ‘বিদ্যা’, আছে রঙ্গিনী ‘মায়া’, আছে অসৎ ব্যবসায়ী ‘শেঠ সোনাচাঁদ ধর্মানন্দ’! এদের সঙ্গে নিজস্ব নিয়তি রচনা করতে বসে রাজ। পরিশেষে সে যে বিদ্যাকেই বরণ করবে, সোনাচাঁদের জালিয়াতি প্রকাশ্যে আনবে, তা প্রত্যাশিতই। ভবিষ্যতের রাস্তায় একই রকম সঙ্কট তখন তো দেশেরও। জনতা আশায় থাকে, এক দিন সোনাচাঁদদের কুকীর্তি ফাঁস হবে, পুলিশের গাড়ি টেনে নিয়ে যাবে সমস্ত অপরাধীকে, মাথার টুপিটা খুলে রাজ অবিকল চ্যাপলিনের ঢঙে অভিবাদন জানাবে। দু’চোখ মেলে সে দৃশ্য দেখে আশ মেটাবে সাধারণ জনতা।

সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪

সোনার হাত

মাহিমের ছোট্ট বাড়িতে বেড়ে ওঠা, ‘খ্রিস্টান’ স্কুলের ছাত্র জ়াকির হুসেনের কাছে তবলা হয়ে উঠেছিল শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সহজ, স্বাভাবিক। বাবার পাশে বসে ছোটবেলায় শুনেছেন রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিলায়েত খান, বড়ে গুলাম আলি খানের মতো দিকপালকে। পরে বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে স্থান করে নিয়েছেন এঁদের পাশেই, কুড়িয়েছেন বিশ্ববাসীর ভূয়সী প্রশংসা। তবলাকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে, প্রাথমিক ভাবে সঙ্গতের এই যন্ত্রকে যেমন দিয়েছেন স্বতন্ত্র মর্যাদা, তেমনই সঙ্গতকে করে তুলেছেন এক অপূর্ব মধুময় অভিব্যক্তি। তাঁর বৈচিত্রময় জীবনে ঠাঁই পেয়েছে সিনেমায় অভিনয়ও: হিট অ্যান্ড ডাস্ট, সাজ়, ভানাপ্রস্থম প্রভৃতি ছবিতে। বিটলস, জর্জ হ্যারিসন, মিকি হার্ট, ভিক্কু বিনায়করাম প্রমুখ আন্তর্জাতিক সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গেও কাজ করেছেন। ভূষিত হয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণে, গ্র্যামি পেয়েছেন একাধিক বার, কিন্তু তাঁর পা হারায়নি মাটির স্পর্শ, অন্তর ভোলেনি শিকড়ের টান। অগ্রজ, সমসাময়িক ও নবীন শিল্পীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ভালবাসার পাত্র। আমজাদ আলি খান সাহেবের মতে, তিনি ছিলেন এই গ্রহের সবচেয়ে ভালবাসা পাওয়া সঙ্গীতকারদের এক জন।

প্রথম যখন ওঁকে লাইভ শুনি, তখন এম এ ক্লাসে পড়ি। গোটা অনুষ্ঠান জুড়ে শুধু অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগলাম: চোখ খুলে দেখলে মনে হয় ঠিক শোনা হচ্ছে না, আবার চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, দেখে নিই একটু, আর তো বেশি ক্ষণ এই মানুষটাকে দেখতে পাব না সামনে থেকে। যেমন চেহারা, তেমন চোখ, মুখ, ও শরীরে ছন্দের অভিব্যক্তি, সোনার ওই হাত দুটোর কথা নাহয় বাদই দিলাম। জ়াকির হুসেন এক অভিজ্ঞতার নাম। শুনেছিলাম পেশকারি কী আবেগময় হতে পারে, শুনেছিলাম খানদানি কায়দা আধুনিকতার মোড়কে কতটা নতুনত্ব বহন করতে পারে। শুনেছিলাম তবলায় বৃষ্টির বোল, প্রথমে ঝিরঝির, পরে মুষলধারে, সঙ্গে মেঘের গর্জন, বাজ পড়া, শুনেছিলাম তবলায় হরিণের চাল, শুনেছিলাম প্রসিদ্ধ ডমরু আর শঙ্খের যুগলবন্দি, আরও কত কী। দেখেছিলাম ‘রিদম’কে কী অনায়াস সারল্যে আর আনন্দে বাজানো যায়; দেখেছিলাম, কেমন মন্ত্রের মতো অনিবার্য সমে ফেরা যায়। দেখেছিলাম, সাধনা দিয়ে তবলাকে কেমন যা ইচ্ছা বলানো যায়।

তার পরে কত বার শুনেছি ওঁকে। বেশির ভাগ একক তবলা লহরা, কখনও অন্যদের সঙ্গে: পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সঙ্গে সঙ্গত করলেন, কখনও রাকেশ চৌরাসিয়ার বাঁশির সঙ্গে, কখনও নীলাদ্রি কুমারের সেতারের সঙ্গে। সেই প্রথম দিনের বিহ্বলতা আজও একই রকম।

উনি না এলে হয়তো এই পৃথিবীটা জানতেই পারত না— তবলাও ও-রকম ভাবে বাজে। উনি না এলে আজ হয়তো ভারতে এত মানুষ তবলা শিখতেন না, বাজাতেন না। রবিশঙ্কর আর সেতারের মতো, শিবকুমার আর সন্তুরের মতো সমগ্র বিশ্বে তবলা আর জ়াকির হুসেন সমনাম হয়ে রইল। ভারতের সাঙ্গীতিক মুগ্ধতা যদি মানুষ রূপ পেত, তা হলে তাকে দেখতে হত উস্তাদ জ়াকির হুসেনের মতোই।

শেষ বার শুনলাম গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর। একক তবলা, সারেঙ্গিতে সাবির খান। সে দিনেও অনুষ্ঠান শেষে কথা দিলেন, পরের বছর আবার দেখা হবে কলকাতাবাসীর সঙ্গে। যখন বেরিয়ে আসছি, তিনি স্টেজে দাঁড়িয়ে মাইকে কথা বলছেন। সব আলো এসে পড়েছে ওঁর গায়ে। আজ কেবলই বেরিয়ে আসার সময়কার, একটু একটু করে দূরে সরে যাওয়া ওঁর অবয়বটা মনে পড়ছে। এক বার যদি জানতাম সেই শেষ দেখা ওঁকে, সেই শেষ সামনে বসে ওঁর বাজনা শোনা, তা হলে নিশ্চিত ভাবেই থেকে যেতাম তিনি যত ক্ষণ থাকতেন মঞ্চে।

কার সঙ্গে না বাজিয়েছেন! কোনও সাঙ্গীতিক ধারা, দেশের মানচিত্র, ঐতিহ্যর ভিন্নতা ব্যবধান গড়তে পারেনি। ভীমসেন জোশীর ভজন, হরিহরণের গজল, ‘শক্তি’র ফিউশন, রবিশঙ্করের সেতার, শিবকুমারের সন্তুর, হরিপ্রসাদের বাঁশি বা জ্যাজ় কোলাবোরেশন, তাঁর হাতে তবলার বাণী পূর্ণতা দিয়েছে সঙ্গীতের সব পরিসরকেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে, তবলাটা যেন এই সঙ্গীতের জন্যেই তৈরি।

উস্তাদ জ়াকির হুসেন, যিনি এক পৃথিবী মানুষকে নিস্তব্ধ করে গত ১৫ ডিসেম্বর পাড়ি দিলেন চিরসুর ও ছন্দের দুনিয়ায়। কত শ্রবণ পড়ে রইল, পড়ে রইল তবলায় বাঁধা রাধাকৃষ্ণের গল্প, বাচ্চাকে মায়ের বকুনি, গ্রহদের চালের চক্রদার। সুর-লয় সৃষ্ট সহজ আনন্দে, শিশুর সারল্যমাখা ওই অমলিন হাসিতে, অসম্ভব বাজনার মহিমাতেই অগুনতি ভক্তের মনে থেকে যাবেন তিনি। সেই অক্ষয়প্রতিমার নেই কোনও বিসর্জন, নেই জরা, নেই মৃত্যু!

আজ শুধু বার বার উস্তাদ রইস খানের কথাটাই মনে পড়ছে। ইউটিউবের রেকর্ডিং, বসন্ত বাহার আর্কাইভের। ১৯৮৯ সাল। বাজাচ্ছেন নন্দ-কল্যাণ, তবলায় জ়াকিরজি। ঝালায় না ধিন ধিন না-র নাটকীয় কথা বলে ওঠা শুনে, সেতার খানিক থামিয়ে বলছেন: “পুরি দুনিয়া মে এক হি হ্যায় জ়াকির!”

সৌভিক মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১০৩

অন্য বিষয়গুলি:

Raj Kapoor film Director Actor Birth Centenary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy