প্যারিসে করোনা-ত্রাস। ছবি: এএফপি।
চিঠি এক) বেঙ্গালুরুতে সবই মিলছে, সমস্যা শুধু অনলাইন ডেলিভারি
আপনাদের ওয়েবসাইটে দেখলাম লকডাউনে বেঙ্গালুরুর অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু এটা পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা থাকি হোয়াইটফিল্ডে। বেঙ্গালুরু জুড়েই বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীরা রয়েছেন। এখানে সমস্যা কিন্তু শুধু অনলাইন ডেলিভারি নিয়ে। স্থানীয় দোকান খোলা রয়েছে। সবজি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। মুরগির মাংসের দোকানও খোলা। সবজির দাম অবশ্য একটু চড়া। কিন্তু তা পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশের গাড়িও ঘোরাফেরা করছে।
তমিস্রা, বেঙ্গালুরু
চিঠি দুই) কয়েক সপ্তাহ আগেও বুঝিনি এ রকম হতে চলেছে প্যারিসে
সর্বত্র যেন একটা আতঙ্ক। কয়েক সপ্তাহ আগেও আমরা বুঝিনি যে এ রকম একটা কিছু একটা হতে চলেছে। তখন এক-দুই করে বাড়ছিল সংখ্যাটা। অফিস, দোকান-বাজারে করোনা নিয়ে হালকা মেজাজে আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা হচ্ছিল। দেখতে-দেখতে ইরান আর ইটালিতে যখন করোনা মহামারী হয়ে উঠল, তখনও এখানে আমরা বুঝতে পারিনি কী হতে চলেছে। তখন এখানে মোট আক্রান্ত নব্বই জন। সেটা পরের দিন যখন বেড়ে একশো নব্বই ছুঁয়ে ফেলল, তখনও সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। তার পরের কয়েক দিনে বিস্ফোরণের মত বেড়ে গেল করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা। আর এখন তো অফিস যাওয়াই বন্ধ। ল্যাপটপ নিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করতে হচ্ছে সবাইকে। লকডাউন। প্যারিসের যে রাস্তায় আগে রাত দু’টোর সময়ও আমি মানুষকে জটলা করতে দেখেছি, গিটার বাজিয়ে গান করতে দেখেছি, সেই সব রাস্তা দিনের বেলায় খাঁ-খাঁ করছে। কত দিন এরকম চলবে জানি না। আর জানা নেই এর পর কী হবে।
একটা ভাইরাস ‘সর্বশক্তিমান’ মানুষকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। লোকজন রীতিমতো পাগলের মতো বাজার থেকে রেডিমেড নুডলস, পাস্তা, তেল, চাল কিনে নিয়ে গিয়েছে। অনেক দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। বড়ো সুপার-মার্কেটগুলোও(এখানে এগুলোকে সুপার-মার্শে বলে) প্রায় শূন্য।
তবু এত খারাপের মধ্যে যেটা ভাল লাগছে তা হল, একে অন্যের জন্য সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন। সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় বেরিয়ে করতালি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে সেই সব মানুষদের, যাঁরা ভয় আর বিপদ উপেক্ষা করে মানুষের জন্যে কাজ করছেন। দেশের বর্ডার ক্লোজডাউন হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। ফ্রান্স, ভারত, ইটালি, জার্মানি, চিন, ইরান, আমেরিকা— প্রত্যেকেই প্রত্যেকের খবর রাখছে। ভাল লাগছে যখন আমার বিদেশি বন্ধুও ভারতের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিছুদিন আগে দালাই-লামার একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম, যাতে তিনি বলছেন ‘বেসিক হিউম্যান নেচার ইস কমপ্যাসন’। বিপদের দিন সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যয় দিচ্ছে যে এই বিপদ কাটবে।
অরিত ভট্টাচার্য, প্যারিস, ফ্রান্স
চিঠি তিন) ধ্বংসের মুখে পর্যটন শিল্প
পর্যটন শিল্প ভারতীয় অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এবং এর দ্রুত প্রসার ঘটছিল। বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন পরিষদের ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ১৬.৯১ লক্ষ কোটি টাকা, যা ভারতীয় জিডিপি-র ৯.২% এবং ৪ কোটি ২৭ লক্ষ কর্মসংস্থান করে এই শিল্প।
যখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে, বেকারত্ব নিয়ে হা-হুতাশ-এর প্রতিধ্বনি সর্বত্র, তখন পর্যটন শিল্প দেশের আর্থিক ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এক বড় ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতেও থাবা বসিয়েছে। এই বিপর্যয়ে ভারতের পর্যটন ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হোটেল, ট্রান্সপোর্ট, ট্র্যাভেল এজেন্সিদের মাথায় হাত। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও কালিম্পঙের বেশির ভাগ হোটেল আর সিকিমের হোটেলগুলির বেশির ভাগই লিজ নিয়ে চালান এ রাজ্যের বাঙালি ও অবাঙালিরা। একে তো লিজের টাকার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের বেশি দেওয়া হয়েছে। তার উপর হোটেলের কর্মচারী ও অন্যান্য খরচ, হোটেল মালিকদের বকেয়া অর্থের চাপে দিশাহারা তাঁরা।
অরিন্দম দত্ত, ঝাড়গ্রাম
চিঠি চার) কমছে না মৃত্যু, তবু হাল ছাড়েনি বেলজিয়াম
পয়লা মার্চ। এক সপ্তাহের বসন্তের ছুটির শেষে বেলজিয়ামে ফিরলেন প্রচুর মানুষ। আর পরের দিন থেকে শুরু হয়ে গেল করোনার প্রকোপ। আজ এক মাস পরে এ দেশে করোনা আক্রান্ত ১৫ হাজারেরও বেশি, মৃত এক হাজারেরও বেশি। ১৩ মার্চ থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়েছে। আর কী আশ্চর্য, সে দিন থেকে এক একটা দিন শুরু হচ্ছে ঝলমলে রোদ নিয়ে। ম্যাগনোলিয়া গাছগুলো ফুলের ভারে ঝুঁকে পড়ছে, কিছু টিউলিপ ফুটেছে রাস্তার প্রান্তের ছোট্ট বাগানগুলোতে। প্রকৃতির এত আয়োজন, কিন্তু এ বছর তার কদর করার লোকেরা সবাই গৃহবন্দি।
বেলজিয়ামের লোকজন এমনিতে বেশ হাসিখুশি, সকাল-বিকেল রাস্তায়-পার্কে-বাসে-ট্রেনে-দোকানে অচেনা লোককেও ডেকে প্রীতি সম্ভাষণ করেন। কিন্তু এই করোনার জেরে এখন সে সব ফিকে হয়ে এসেছে। সুপারমার্কেটে বাইরে সবাই দু’মিটার দূরত্বে দাঁড়াচ্ছেন নিয়ম মেনে। সবাই যেন ম্রিয়মান। একে অপরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন, কে কাশছেন, কে হাঁচলেন-তার হিসেব রাখছেন সবাই।
ব্রাসেলসে আমাদের পাড়াটা এমনিতে শান্ত। সবচেয়ে পুরনো বাড়িটা আমাদের উল্টোদিকেই, ১৮৯৫ সালে তৈরি। পাড়ার বাসিন্দারাও মোটামুটি বয়স্ক ও বেশির ভাগই নিঃসঙ্গ। এই ক’দিনে অগুণতি অচেনা মুখ দেখলাম বিভিন্ন বারান্দা, জানালায়। আমার দুটো বাড়ি পাশের বারান্দায় হঠাত্ দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা হাততালি দিলেন দু’দিন ধরে, মৃদু হাসলেন আমাকে দেখে। তার পর তিন দিন তাঁর দেখা না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, অসুস্থ হলেন না তো! চতুর্থ দিন দেখা পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। রাস্তার উল্টো দিকে ঠিক সামনের ফ্ল্যাটটায় আরেকজন ষাট ছুঁইছুঁই ভদ্রমহিলা থাকেন। গত তিন বছরে হাতে গুনে হয়ত সাত বার বারান্দায় এসেছেন, আমার সাথে আলাপ হয়নি কোনও দিন। আজ দু’সপ্তাহ ধরে হাততালির সময় এক দিনও বাদ পড়েননি। গত সপ্তাহে আমরা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, হাততালির সময়ের মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারিনি। খানিক পরে ফিরে আলো জ্বালিয়ে রান্নাঘরে হাত ধুচ্ছি, দেখি উল্টো দিকের ভদ্রমহিলা বারান্দায় এলেন। আমাকে দেখে হাত পা নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন হাততালির সময় ছিলাম না কেন, সব ঠিক আছে তো? আমিও ইশারায় উত্তর দিলাম যে হাঁটতে গিয়েছিলাম। তিন বছরের দূরত্ব এক লহমায় ঘুচে যায় যখন রোজ তাঁর সঙ্গে বারান্দায় দেখা হয়, হাততালি শেষে একে অপরকে বিদায় জানিয়ে আবার যে যার ঘরে ঢুকে পড়ি।
প্রিয়াঙ্কা রায় বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাসেলস, বেলজিয়াম
চিঠি পাঁচ) চাকরি নেই, লকডাউনে খুব সমস্যায় পড়েছি
আমি স্বপনকুমার মহাপাত্র। ডিপ্লোমা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। হলদিয়ার নিজের পরিবারের সঙ্গে বাস করি। আমার সাত বছরের কন্যা প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। জানুয়ারির শেষে আমার চাকরি চলে যায়। প্রায় দেড় মাস পর নতুন এটা চাকরির সংস্থান করতে পেরেছি আমি। গত ১৮ মার্চ সেই চাকরিতে যোগদানের তারিখ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত করোনাভাইরাসের জেরে রাজ্য জুড়ে যে লকডাউন চলছে, তার কারণে এখনও চাকরিতে যোগ দিতে পারিনি।
এর মধ্যে আমার মেয়ের স্কুল থেকে জানিয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তির তারিখ আগামী ১৫ এপ্রিল। ভর্তির জন্য ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল-এই তিন মাস কোনও কাজ নেই হাতে। তার উপর বাড়ি ভাড়া, খাবার, রান্নার গ্যাস, স্কুল বাস, স্কুলের পোশাক ইত্যাদি নানা খরচ লেগেই রয়েছে। এই মুহূর্তে লকডাউনের জেরে ভীষণই সমস্যার মধ্যে রয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা করছি।
স্বপনকুমার মহাপাত্র, হলদিয়া
চিঠি ছয়) মার্কিন মুলুকে এখনও কোনও জিনিসের দাম বাড়েনি
গত ৩ মার্চ আনন্দবাজার ডিজিটাল-এ প্রকাশিত লকডাউন সম্পর্কিত অনিন্দ্য রায়ের নিবন্ধ ‘চিনের শহর থেকে লিখছি...’-র প্রেক্ষিতে এই পত্র। উক্ত নিবন্ধে উনি বলেছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় লকডাউন পরিস্থিতিতে আকাশছোঁয়া দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সুপারমার্কেটের তাকগুলো খালি পড়ে আছে।
এই কথার প্রতিবেদেই আমার চিঠি। ইউরোপের কথা জানি না, কারণ আমি ইউরোপে থাকি না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে এটুকু বলতে পারি যে আমেরিকা বা মার্কিন মুলুকে এখনও পর্য়ন্ত কোনও জিনিসের একটুও দাম বাড়েনি এবং লকডাউনের চার সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরেও সুপারমার্টেরে তাক জিনিস দিয়ে ঠাসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাম নির্ধারণের বিরুদ্ধে খুব কঠোর আইন রয়েছে, সুতরাং নিবন্ধগুলি প্রকাশের আগে এই জাতীয় দাবিগুলি যাচাই করা উচিত।
ঈপ্সিতা সেন, ক্যালিফোর্নিয়া
চিঠি সাত) দু’সপ্তাহ ঘরে বন্দি তবু ‘উফ’ বলতে শুনিনি
আমার পুত্র ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট কবে বার হবে কেউ জানে না। তার উপর এই লম্বা করোনার ছুটি।
কিন্তু সারাদিন সে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। সকালের টেলিগ্রাফ, টেলিকিডস একপ্রস্থ মুখস্থ করে। তবে করোনা বিষয়ের খারাপ খবর ওর না-পসন্দ। ক'জন সুস্থ হলো সেই খবরটি রাখে।
এ ছাড়া, বাইরের বইপত্র পড়ছে। দু’সপ্তাহ ঘরে বন্দি তবু ‘উফ’ বলতে শুনিনি। বাবাকে কখনও সারা দিন বাড়ি বসে অফিস করতে দেখেনি। বাবার এত দিন বাড়িতে থাকা এবং গৃহবন্দি থাকা ওর কাছে নতুন আর অদ্ভুত এক আনন্দের অনুভূতি। রবিবার ছাড়া কখনও সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দেখতে পেত না। এখন ওর সকালের চাহনিতে সেটা বুঝতে পারি।
হয়তো বাবার মতোই মনে মনে লকডাউনকে অনেক ধন্যবাদ জানায় এই নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য, বাবাকে জীবনে প্রথম দু’সপ্তাহ সারা দিন কাছে পাওয়ার জন্য।
শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেশতলা, কলকাতা ১৪১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy