আজ প্রায় দেড় মাসেরও বেশি হয়ে গেল আমরা আমেরিকার বাসিন্দারা সকলেই লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে গৃহবন্দি । দেশবাসীকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করতেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে মার্কিন সরকার। সংক্রমণ থেকে সকলকে দূরে রাখতে স্কুল , কলেজ , অফিস , দোকান, সেলুন , জিম , স্পোর্টস ফিল্ড, পার্ক , সমুদ্র সৈকত সব কিছুই এখন বন্ধ। কারণ এই সমস্ত জায়গায় গেলে অন্যদের কাছাকাছি আসার , ছোঁয়াচ লাগার চূড়ান্ত সম্ভাবনা রয়েছে । বীভৎস মৃত্যুবাণ এই বিশাল পৃথিবীর যেখানেই আঘাত হেনেছে সকলের জীবন যাত্রা একেবারে তছনছ করে দিয়েছে এবং ক্রমাগত এখনও দিয়েই চলেছে এক যন্ত্রণাময় বিভীষিকা।
জীবধারণের তাগিদে সাধারণ মানুষকে মাঝে মধ্যে বাইরে যেতে হচ্ছে। সুপারমার্কেট এবং দোকান-বাজারে গেলে কিছু হাইজিনিক প্রোটোকল অবশ্যই মেনে চলতে বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। যেমন, মাস্ক পরা, বাড়ির বাইরে যেখানে সেখানে হাতের ছোঁয়া লাগলেই স্যানিটাইজার মাখা বা সাবান জলে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি । কিন্তু, জীবনকে তো আর বেশি দিন আর ঘরবন্দি করে রাখা যায় না । সে যে গতিশীল, বহমান । সে যতই ‘মানবজাতির কল্যাণার্থে’ হোক না কেন, জোর করে বাঁধতে গেল সে-ও একদিন বাধা না মেনে রাস্তায় নেমে আসতে পারে। উথলে ওঠা বিশাল জনতরঙ্গের ঢেউ তছনছ করে দিতে পারে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে সকল নিয়ম কানুনের আকাশছোঁয়া প্রাচীরগুলিকে।
খুব শীঘ্রই হয়ত আমেরিকার কিছু রাজ্যে এমনটা হতে চলেছে। রকি পর্বতের সুউচ্চ তুষারমণ্ডিত পর্বতমালা দিয়ে সুসজ্জিত, শান্ত, মিষ্টি স্বভাবের আমার এই ডেনভার শহরেও এর আঁচ লেগেছে । এই তো সে দিন ডেনভার-স্টেট -ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের সামনে এই ‘লকডাউন’-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হল।
আরও পড়ুন: টাকা থেকেও আজ মূল্যহীন টাকা
এই দুনিয়ায় ক’জন কর্মজীবীরই বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম ’ করার সৌভাগ্য থাকে? অবশ্য আমি এটা বলছি না যে বিনা পরিশ্রমেই ওঁরা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন । যথেষ্ট মানসিক পরিশ্রম, প্রচুর মনোযোগ ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয় বইকি । তবু, মার্কিন যুক্তরাষ্টের একটি মস্ত বড় অংশ জুড়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের জীবনে ছেয়ে গিয়েছে এই লকডাউনের কালো ছায়ায়। প্রচুর ছোট বড় এস্টাব্লিশমেন্টগুলি সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসংখ্য মার্কিন নাগরিকের কাজ চলে গিয়েছে । ফেডারেল গভর্নমেন্ট এবং স্টেট গভর্নমেন্ট তাঁদের সকলের জন্য একজোট হয়ে আগামী ছয় থেকে আট মাসের জন্য ‘আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট’-এর ব্যবস্থা করেছেন এবং এককালীন সাহায্য হিসেবে আমেরিকার অধিকাংশ নাগরিকদের জন্যও ঘরে ঘরে চেক পৌঁছে দিচ্ছেন ।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় সকলকে মহামারির ছোবল থেকে রক্ষা করতে মার্কিন প্রশান আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে । কিন্তু এই বিশাল মহাদেশে সকলের জন্যে সব কিছু করা তো সত্যিই অসাধ্য । এক মাত্র সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই পারেন এক লহমায় সকলের সব জ্বালা -যন্ত্রণা মিটিয়ে করোনাভাইরাসের করাল থাবা থেকে সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করতে, এক নতুন জীবনের আশ্বাস প্রদান করতে । কিন্তু এর পরেও অনেকেই এই অদ্ভুত পরিস্থিতি, অনিশ্চয়তা এবং দুশ্চিন্তায় ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেদের আর রুখে রাখতে পারছেন না । আজ তাঁরা অত্যন্ত দিশেহারা হয়েই পথে নেমে পড়ার সংকল্প নিয়েছেন ।
তবুও আমি বলবো, আমাদের সকলকেই নিজেদের ভালর জন্যেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে । এই ‘লকডাউন’ পরিস্তিতি যতই অসহ্য, দম বন্ধ করা এবং যন্ত্রণাদায়ক মনে হোক না কেন, এটি তুলে মাহামারি থাবা বসাকতে পারে আমাদের সকলের জীবনে। এত বিশাল জনসমাজ যখন বিশেষ ভাবে নির্ধারিত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মগুলি উপেক্ষা করে ‘আগের জীবনে’ ফিরে আসতে চান, বিপদ বাড়ার আশঙ্কা প্রবল ভাবেই থেকে যায় । অধিক মানুষের সংস্পর্শে এলে নিজের অজান্তেই অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। সারা দেশে আবার নতুন করে বিভীষিকার ঢেঊ আছড়ে পড়তে পারে । তাই আমার মতে, যদি আমেরিকা বা পৃথিবীর অন্য কোথাও এই ‘লকডাউন’ তুলে নেওয়া হয়, তা যেন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রোটোকলগুলি কঠোর ভাবে মেনেই করা হয়। যদি কেউ ভেবে থাকেন যে কেবল মাত্র বিলাসিতার জন্যে এই লকডাউন তোলা হবে, তাহলে হয়তো খুবই ভুল ভাবা হবে । করোনাকে নিজেদের জীবনে আবার নতুন করে আমন্ত্রণ জানানোটা বোকামো এবং অযৌক্তিক হবে।
আরও পড়ুন: লকডাউনে চোর-ডাকাত সামলাতেই হিমসিম লাগোস
যাঁরা ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন, সেই শতাধিক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, দমকলকর্মী নিজেদের জীবন আমাদের সকলের জন্যে উৎসর্গ করে দিচ্ছেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। বিধিনিষেধ অমান্য করে আচমকা রাস্তায় নেমে এলে এঁদের প্রতি অন্যায় করা হবে । শুধু কি তাঁরাই? যাঁরা দোকান-বাজারগুলিতে সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন, তাঁদের কথাও একবার ভাবুন। পোস্টম্যান এবং যাঁরা অনলাইনে অর্ডার দেওয়া খাবার বা অন্যান্য জিনিস ডেলিভারি দিতে আসছেন তাঁরা? তাঁদের মতো আরও অসংখ্য মানুষ যাঁরা আমাদের সকলের জন্য এক বুক সাহস নিয়ে ক্লান্তি, ক্ষুধা ভুলে কাজ করে চলেছেন অবিরাম, তাঁদের তো নিজেদের জীবন বলতে আর কিছুই রইল না । তাঁরা যদি একটুও বিশ্রাম না পান, তবে এই ভাইরাসের কবল থেকে নিজেদের কি আর কোনও ভাবে রক্ষা করতে পারবেন? তাঁরাও তো আমাদেরই মতো সাধারণ জীবনধারায় বিশ্বাসী । তাঁদের শরীর-মনে তো অবসাদ নেমে আসবেই । বিষণ্ণ্তা গ্রাস করতে পারে তাঁদের বিচার , বুদ্ধি এবং মানসিকতাকে। আমি মনে প্রাণে এটাই বিশ্বাস করি যে, এঁরাই আমাদের এই বিশাল মহাদেশের মেরুদণ্ড, যাঁদের অস্তিত্ব ছাড়া এই দেশের কাঠামোটাই একেবারে নড়বড়ে হয়ে যাবে । তাই , যাঁরা এই লকডাউনের বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসতে চান, তাঁরা যেন খুব সাবধানী হন। যতটা পারেন প্রোটোকলগুলি মেনে চলার চেষ্টা করুন। তাতে নিজেদের পাশাপাশি দেশবাসীরও মঙ্গল।
এই সঙ্কটময় অবস্থা আরও কত দিন চলবে, তা সত্যিই জানা নেই। সকলেই সুস্থ, সুন্দর, সাবলীল জীবন কাটাতে চান। এটা সকলেরই অধিকার। কিন্তু এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস নামক ভয়ঙ্কর শত্রুটিকে নির্মূল করতে বিশ্ব জুড়ে মহাযুদ্ধ চলছে। আমরা সকলেই সেই সুবিশাল যুদ্ধক্ষেত্রের এক একজন বীর যোদ্ধী। সকলের মিলিত প্রচেষ্টাতেই এক দিন ঠিক জয়ী হব।
রুচিরা রায় বর্মণ
স্মোকি হিল (ডেনভার), কলোরাডো, আমেরিকা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy