সপরিবারে চৈতালি তরফদার।
৭ই এপ্রিল থেকে জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র ছাড়া বাকি জায়গায় তালাবন্ধ। যাঁরা জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের বাচ্চাদের দেখাশোনার ব্যবস্থা করবে স্কুলই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ লকডাউন করেছে অনেক আগেই। ভারতে তো অনেকদিন থেকেই বন্ধ। সিঙ্গাপুরে মা-বাবারা মৃদু দাবি তুলছিলেন কিছু দিন আগে থেকেই। কিন্তু এখানকার সরকারের উপর ভরসা থাকায় আমি বিশেষ বিচলিত হইনি। আমি নিশ্চিত জানি ও মানি, এরা যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কাজটি করবে। আমি এদের সার্স ম্যানেজ করতে দেখেছি, যে কোনও কাজ এরা যে দৃষ্টিভঙ্গি, তৎপরতা এবং সততার সাথে করে, তা এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা দেয়। স্কুল বন্ধ করার আগে বাড়িতে থেকে শেখার ব্যবস্থাকে এরা নিশ্চিত করেছে। প্রাইমারি থেকে কলেজ – অন লাইনে ক্লাস চলবে। শিক্ষক শিক্ষিকারা তৈরি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে।
সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রতি ভাষণে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন। তার পর বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে সমুদ্র, দেখে বোঝার উপায় নেই যখন আজ আমরা, এই মনুষ্যজাতি বারে বারে নিজেদের দোষারোপ করছি প্রকৃতিকে রুষ্ট করার জন্য, তখনও সূর্যাস্তের আভায় আকাশের রঙের ঘনঘটায় মনে হয় যেন কোথায় ক্রোধ! প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য উজাড় করে আনন্দ বিতরণ করছেন, মনের আশঙ্কা, সংশয় দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন। সত্যি, এই প্রকৃতিই কখনও কখনও এমন প্রাণ মন জুড়িয়ে দেওয়া সুন্দর, আবার কখনও বা এমন কঠিন, প্রাণঘাতী নিষ্ঠুর! ভাবতে ভাবতে দেখলাম, তিনটে টেনিস কোর্টে খেলায় ব্যস্ত ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধাভোগীরা। প্রায় ৩০টা ছোট ছেলেমেয়েও মাল্টিপারপাস কোর্টে এবং সুইমিং পুলে নজরে পড়ল। ১৪ তলা থেকে কে বা কারা এরা, বোঝা সহজ নয়। তবে পথে ঘাটে নানা ভাষাভাষী মানুষের এই দেশে গতকালও দেখেছি বাসস্টপে বা এমআরটি স্টেশনে, সাবধান হওয়া বা নিজেকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা বড়ই কম। এদের কী ভয়ডর নেই? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ভীষণ ভয় চেপে বসল, সত্যি আমরা কি কেউ জানি কাল আমার কি হতে পারে? বড় মেয়েটার জন্য ভীষণ মন কেমন করে, লন্ডনে একটা ছোট্ট এ্যাপার্টমেন্টে মোটামুটি বন্দি, সেও বাড়ি থেকেই কাজ করছে, সিঙ্গাপুরে দু’বছর বয়স থেকে বড় হবার সুবাদে নিয়ম মানাই তার অভ্যাস। মুদিখানার দোকানে যাওয়া ছাড়া নেটফ্লিক্স, স্পোটিফাই, কিন্ডল আর কাজ নিয়ে আছে। আজ
ব্রিটেনের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে বারে বারে মনে হচ্ছে মরীচিকার পেছনের ধাওয়া করলাম নাকি এতদিন! পরাবাস্তব জগতে তো তাকে দেখছি প্রতিদিন। কিন্তু আজ যেন এ দেখায় শান্তি নেই! আজ যে শুধু চারজনে এক ছাদের তলায় একসাথে থাকতে চাই। একসঙ্গে থাকলে মনের জোরটা অনেক বেশি হত। ছোট জনকে কাছ ছাড়া করা নয়, যতদিন পারব কাছেই রাখব, এসব ভাবনাও মনে আসছে। করোনার প্রকোপের কারণে বার বার বলেছিলাম সিঙ্গাপুরে চলে আসতে। এদেশ কিন্তু একটা ভরসাস্থল। কিন্তু যদি এখানে এসে আটকে যায়, তাই আমার জ্যেষ্ঠা রাজি হল না।
ফেব্রুয়ারিতে চার দিনের জন্য ভাইপোর বিয়েতে কলকাতার ঘুরে এলাম। অবাক কান্ড, ১১ই ফেব্রুয়ারিতেই কলকাতায় মাস্ক পেলাম না। অথচ কাউকে পরতে তো দেখিনি! তখনও তো ভারতবর্ষ শুধু বিমানবন্দরে চিন ভ্রমণ করিনি এই মর্মে মুচলেকা আর তাপমাত্রা স্ক্রিনিংয়ের বেশি আর কোনও করোনা সম্পর্কিত আবহ ছিল না। ভাইপোর বিয়েতে অতিথিদের ভিড়, হুল্লোড় সবই হয়েছিল।
মার্চের শুরুতে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় আর জয়তী চক্রবর্তীর মে মাসে এখানে যে অনুষ্ঠানটা হবার কথা ছিল তা বাতিল হল। টেগোর সোসাইটির তরফে আমাকে অনুষ্ঠানটি আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অধীর আগ্রহকে আশঙ্কার দোলায় ভাসাতে বেশ কষ্ট হল, নেতিবাচক কিছু বলা বা করায় আনন্দ কোথায়! অগষ্টে হবে অনুষ্ঠান, এমনটা ভেবেছিলাম। ২৫শে বৈশাখে না হোক ২২শে শ্রাবণে তাঁকে স্মরণ করব যিনি আমাদের চিরসখার কাছে আকুলতা জানাতে বলেছেন। কিন্তু অগষ্টে হতে পারবে কী! কেমন যেন ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি না। আশা করি ‘চিরসখা’ তাঁর সৃষ্টির বিপন্নতাকে এবারে ভারসাম্য দেবেন। এত মানুষের মৃত্যু সংবাদে কেমন যেন গলা বুজে আসে। দেশে থাকা আত্মীয় স্বজন, লন্ডনে আমার আত্মজা থেকে শুরু করে বিশ্বজোড়া সকলের জীবনের অনিশ্চয়তা এখন। সিঙ্গাপুরের দিনে রাতে ঝাঁপ না ফেলা মুস্তাফা সেন্টার যখন ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয়, তখন এক ভীষণ ভয় গ্রাস করে।
আশা করি, দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চার জনে আবার এক ছাদের তলায় দাঁড়াব। এই প্রতীক্ষায় আমি। চিরসখা হে, ছেড়ো না ... হও হে .. অবলের বল। আমরা যে সত্যিই আজ অবল।
চৈতালি তরফদার
সিঙ্গাপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy