ফাঁকা অপেরা হাউস। ছবি: লেখকের নিজস্ব।
বাঁকুড়া জেলার এক শান্ত সুনিবিড় গ্রাম বালসিতে কেটেছে আমার ছেলেবেলা। তার পর পড়াশোনা ও চাকরির খাতিরে কলকাতা, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, আমেরিকা— বিভিন্ন জায়গাতেই ঘুরেছি।
অক্টোবরে যখন মা দুর্গার ঢাকের কাঠি পড়ল, পরিযায়ী পাখির মতো বাঙালি যখন ঘরে ফিরছে, আমি তখন উল্টো স্রোতে পা রাখলাম। আপাতত কর্মসূত্রে মেলবোর্নে এক বছরের জন্য একার সংসার পাতলাম। বউ-ছেলে বেঙ্গালুরুতে, ছেলের পড়াশোনা ও বউয়ের চাকরির জন্য। অস্ট্রেলিয়ার প্রাণচঞ্চল এক কর্মব্যস্ত শহর, ভাল লেগে গেল। এ যেন দীর্ঘ সাত বছর সংসার জীবনের পরে আবার ‘হিন্দু হোস্টেল’-এর জীবন ফিরে পেয়েছি। নতুন শহর। নতুন কর্মস্থল। নতুন বন্ধু। কয়েক দিন খুব ঘুরে বেড়ালাম।
মার্চের শেষে বউ-ছেলের আসার কথা। বিছানা-বালিশ, বাসনকোসন কিনে ঘর সাজালাম। দিন গোনা শুরু হল। মনের মধ্যে এক অজানা আনন্দ!
আরও পড়ুন: ফিরে যেতে পারতাম, কিন্তু চাইনি আমাদের জন্য দেশের এক জনেরও ক্ষতি হোক
কিন্তু হঠাৎ করে কী যেন হয়ে গেল ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। চাদিকে গেল গেল রব উঠল, প্রাণচঞ্চল শহরটা স্তব্ধ হতে শুরু করল। এক দিন অফিসে হঠাৎ খবর এল, সবাই যেন নিজের নিজের বাড়ি চলে যায় ও খবর না দেওয়া পর্যন্ত যেন কেউ ফিরে না আসেন। আর শুধু যেন বাড়িতেই থাকেন সবাই। শুনলাম, এক সহকর্মী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। মনের অজানা আনন্দটা এক অজানা ভয়ে রূপান্তরিত হল। সরকারও বাড়ি থেকে কাজ করার পরামর্শ দিল। বন্ধ হল সমুদ্র সৈকত, সব রকম জমায়েত, রেস্তরাঁ, অনুষ্ঠান ও হইচই। বহু প্রতীক্ষিত ফর্মুলা ওয়ান কার রেসিং, অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লিগ, ক্রিকেট— সেও পার পেলো না।
আরও পড়ুন: স্তব্ধ ইটালিতে বারান্দা থেকে ঝুলছে ঝুড়ি! কেউ খাবার নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ রেখে যাচ্ছেন
‘ডাটা সায়েন্স’ নিয়ে কাজ করার দৌলতে ভবিষ্যৎ একটু একটু করে বদলানোর আভাস পেলাম। মেলবোর্নের অর্থনীতি অনেকটাই শিক্ষা ও ভ্রমণের উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই আসে চিন এবং ভারত থেকে। সে দরজা এখন বন্ধ। স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং তার পাশাপাশি নির্ভরশীল ছোট ব্যবস্যার রোজগারে টান পড়তে শুরু করলো। তা ছাড়া চিন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক বেশ ভাল এবং ব্যবসায়িক নির্ভরতাও গভীর। তাই এই সাময়িক দূরত্ব যেন অর্থনীতির পারদ আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিল। এক বছরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৃতীয় রেট কাট হয়ে দাঁড়াল ০.২৫। আমার মতো স্বল্প সময়ের জন্য বিদেশে চাকরি করতে আসা ভারতীয়দের মাথায় হাত পড়ল যখন অস্ট্রেলিয়ান ডলার ৫০ টাকা থেকে ৪১ টাকায় পৌঁছল।
খালি সুপার মার্কেট। ছবি: লেখকের নিজস্ব।
চার দিকে শুধু মহামারি ও লকডাউনের গল্প। সর্বনাশ! আমারও তো কিছু কেনার ছিল, দৌড় লাগালাম এক অস্ট্রেলিয়ান ষ্টেশনারি সুপারমার্কেট। কয়েকটা আউটলেট ঘুরে যা পেলাম, তাতে আমার ঘর ভর্তি হল। আঁকার সরঞ্জাম দেখে মন ভরে গেল। মনে মনে বললাম, ‘ডাটা সায়েন্টিস্ট বাই প্রফেশন বাট আর্টিস্ট ফ্রম হার্ট!’ কিন্তু এই আনন্দটাও টিকল না, যখন দেখলাম রান্নাঘরে সবই বাড়ন্ত। অগত্যা আবার বেরতে হলো সুপারমার্কেটে খাবারের সন্ধানে। গিয়ে দেখি, সুপারমার্কেটের তাক তখন খালি হয়ে এসেছে। টয়লেট পেপার নেই বলে নোটিশ লেগেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে এক ভারতীয় স্টোর থেকে চড়া দামে কিছু চাল আর ছোলার ডাল পাওয়া গেল। ফিরে এসে বাড়িতে সবটা খুলে বলার পরে মা আর বউ মিলে তো এই সময় আঁকার জিনিস কিনে ঘর ভরানোর দায়ে আমাকে এক হাত নিল। আরে, অঙ্ক নিয়ে পড়লেও আঁকাটা আমার সব সময়েরই সঙ্গী! আর মারির মরসুমে পেটের মতো মনের খিদেরও কিছু রসদ লাগে!
সুমন পাল, অস্ট্রেলিয়া
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন,feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy