বাংলা বন্ধ দেখেছি, ভারত বন্ধ দেখেছি তবে গোটা পৃথিবীকে এভাবে বন্ধ হতে আমি কেন কেউই বোধহয় দেখেননি। আমার বাড়ি হাওড়ার আন্দুলে। গবেষণার জন্য ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে আসা। এখন গোটা পৃথিবী জুড়ে যা চলেছে, তা প্রত্যকের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে ভয়ানক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। তার পর এত বড় ধাক্কা ইউরোপে এই প্রথম। এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে গোটা ইউরোপ।
ফ্রান্স বিখ্যাত তার সৌখিনতার জন্য। এখানকার মানুষের মধ্যেও সেটা পরিষ্কার ফুটে ওঠে। কিন্তু বিগত একটা মাস যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল ফ্রান্স। সৌন্দর্য এবং সৌখিনতায় ভরা হলেও ফ্রান্স কিন্তু খুব লড়াকু। তারা জানে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে কোথায় কতটা শক্ত হতে হয়। এই পরিস্থিতিতেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ১৭ মার্চ যখন লোকডাউন ঘোষণা হয়, তখন গোটা ইউরোপের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে অগোচ্ছে। বিশেষ করে ইতালির এবং স্পেনের পরিস্থিতি গোটা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছিল বিগত ওই একটা মাসে।
ফ্রান্স সরকার দু’দিনে নিজেদের যাবতীয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় করে নিতে বলেছিল। তার পর ১৯ মার্চ থেকে পুরোপুরি লোকডাউন শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে ফ্রান্স সরকার সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি জায়গায় আর ইন্টারনেট মারফত প্রত্যেকের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে, একটা কঠিন সময় আসতে চলেছে আর তাতে প্রত্যেকের কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়। আরও একটা দিকে ফ্রান্স সরকার নজর রেখেছিল, যাতে কোনওরকম গুজব না ছড়ায়, যা কি না পরিস্থিতিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে।
আরও পড়ুন: সহজলভ্য হোম ডেলিভারি, গভর্নরই অনুরোধ করছেন জগিং করতে, হেঁটে আসতে
দু’টো দিন হাতে পেয়ে মানুষ কোনও প্যানিক করেননি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দোকান বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছেন। তার পরেই ১৯ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে। যত দিন গড়িয়েছে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সাধারণ দিনে স্ট্রাসবুর্গের রাস্তাঘাট গভীর রাত পর্যন্ত মানুষে ভর্তি থাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে তা দেখলে চেনার উপায় নাই। রাস্তা ঘাট, শপিং মল, রেস্তোরা সব বন্ধ। রাস্তার দু’ধারে শুধুই গাড়ির সারি, শুধুই অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ।
ফ্রান্সের সঙ্গে বাকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ওপেন বর্ডার থাকায় মানুষ অবাধে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পারে, আর সেটাই এই ভাইরাস সংক্রমণকে ঢেউয়ের মতো গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। তবে ওপেন বর্ডার হওয়ায় আর একই ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ফ্রান্স, জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ড, লাক্সেমবার্গ নিজেদের মধ্যে সঙ্কটজনক রোগীদের আদানপ্রদান করেছে দরকার মতো। যত দ্রুত সম্ভব লেটা সম্পন্ন হেলিকপ্টার চলেছে নিয়ত।
স্ট্রাসবুর্গ শহরটা ছবির মতো সাজানো। এর ভিতর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ইল নদী। চারিদিকে ফরাসি এবং জার্মান মিশ্র ঘরানায় তৈরি বাড়ি। আর রয়েছে বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল নোত্র দাম। শীতের পর বসন্ত কাল যখন আসে তখন স্ট্রাসবুর্গের চারিদিক ভরে যায় চেরি গাছের ফুলে, যা পরিবেশকে আরও মোহময় করে তোলে। এককথায় ছবি মতো দেখেত লাগে শহরটাকে। এখনও ঠিক তাই। শীতের শেষ ধীরে ধীরে বসন্ত আসছে। চারিদিকে আবার চেরি ফুলে ভরে উঠছে। কিন্তু সেটা উপভোগ করার মতন সময় এখনও আসেনি।
আরও পড়ুন: নতুন বছরে নতুন দিন এর অপেক্ষায় আছি
এখানে প্রত্যেকে লকডাউন মানছেন। নিয়ম করে এক ঘণ্টা ঘরের বাইরে হাঁটাচলা ছাড়া। ডাক্তার বা খুব প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার থাকলে তবেই মানুষ বাইরে বেরোচ্ছেন, তা-ও নিজেদের মধ্যে দেড় থেকে দু’মিটার দূরত্ব বজায় রেখে। এ ভাবেই প্রায দেড় মাস কেটে গিয়েছে। প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর গোটা ফ্রান্সের পরিস্থিতি বিচার হচ্ছে। তার পরই ঠিক হচ্ছে পরবর্তী পদক্ষেপ। এই মুহূর্তে ধীরে ধীরে আক্রান্ত এবং মৃত্যু সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে। সাধারণ মানুষ এবং ফরাসি সরকাররে জন্যই সেটা সম্ভব হয়েছে।
সরকার জানিয়েছে, ১১ মে থেকে ধীরে ধীরে লোকডাউন উঠবে, তবে পুরোপুরি উঠতে সময় লাগবে আরও একটা মাস। এরই মধ্যে দেখা হবে যেন আর নতুন করে কোনও ভাবে এই সংক্রমণ না ছড়ায়। তাই অফিস, স্কুল, কলেজ, আর গবেষণাগারগুলোকে ১১ মে-র পরে পরিস্থিতি বিচার করে ধীরে ধীরে ২৫% করে লোক বাড়াতে বলা হয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। গোটা পৃথিবী আবার আগের মতো হয়ে উঠবে। তবে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার যে, প্রকৃতির কাছে এখনও আমরা কতটা অসহায়।
অভিজিৎ মান্না
পোস্ট ডক্টরাল গবেষক
ইউনিভার্সিটি অব স্ট্রাসবুর্গ
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy