সুনসান কানাডার রাস্তাঘাট। ছবি-লেখিকা।
আমি, ঋত্বিক আর আমাদের একমাত্র কন্যা ৯ বছরের রাইলীনকে নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে দিনগুলো ভালই কাটছিল। বেশ কিছু বছর আমেরিকায় থাকার পরে এখন আমরা কানাডার বাসিন্দা। আমি কানাডিয়ান ব্যাঙ্কের টেকনোলজি ডিভিশনে আর আমার ঋত্বিক স্ট্র্যাটেজিক কনসাল্টিং ফার্মে কাজ করেন। আমাদের দু’জনেরই আদি বাড়ি কলকাতায়।
চিনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পেয়েছিলাম, কিন্তু অফিসে দেখছিলাম সহকর্মীরা ব্যাপারটাকে হাল্কা করে দেখছেন আর আমিও ব্যাপারটাকে সে রকম গুরুত্ব দিইনি প্রথম দিকে।
১২ মার্চ, সকাল সাড়ে ৯টা
দ্রুত হাতে ব্রেকফাস্ট সারছিলাম অফিস কিচেনে। টিভির পর্দায় চোখ পড়ল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ার ট্রুডোকে কোভিড টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। চার পাশে এ সব কি শুনছি? সত্যিই কি এ বার অতিমারি লাগল! ঋত্বিক অফিসের কাজে ‘আউট অফ টাউন’ ক’দিন ধরে, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে একা। উইকএন্ডে ঋত্বিক ফিরবে। শুনছি ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল নাকি রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ওদের কোম্পানি ট্রাভেল বন্ধ করছে না কেন? আশ্চর্য!! ক’দিন পরেই তো আমার ইন্ডিয়া ট্রিপ, কী ভাবে যাব? মাকে এক বার দেখতে চেয়েছিলাম যে! বাবার মৃত্যুর পর তো এক বারও যাওয়া হল না। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষ, এক কাপ কফি ব্রু করতে দিয়ে রেডি ফর ফার্স্ট মিটিং।
দুপুর সাড়ে ১২টা
লাঞ্চ টাইমে টিমের সঙ্গে বসেছি, জাস্ট চ্যাটিং। অন্য দিন এই সময় ওয়ার্ক আউটে দৌড়ই জিম ব্যাগ নিয়ে। সবাই বলছে অফিসে আনলিমিটেড টাইমের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম দিয়ে দেবে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম এক দিন দু’দিন ভাল লাগে, রোজ রোজ বাড়ি থেকে কাজ করা রিয়েলি বোরিং! আমি তো জানি ওয়ার্ক ফ্রম হোমের আর একটা অর্থ হল ওয়ার্ক ফর হোম যেটা আমার পার্সোনাল ফিলিং প্রোডাক্টিভিটিকে নষ্ট করে।
বিকেল ৫টা
অফিসিয়াল ইমেল এসে গেছে। ম্যানেজার সবাইকে রিকোয়েস্ট করেছে ল্যাপটপ/চার্জার আর সব জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। কারণ, সম্ভবত কাল থেকে আমাদের সবাইকেই রিমোট কাজ করতে হবে। পাবলিক ট্রানজিট ধরে বাড়ি ফিরে এলাম, আশ্চর্যই লাগছিল কারণ, অফিস টাইমে ট্রেন এত ফাঁকা কখনও দেখি নি, ট্রেন থেকে নেমে পার্কিং লটও ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।
১৩ মার্চ
অন্টারিওতে নেক্সট উইকএন্ড স্কুলে মার্চ ব্রেকের ছুটি থাকে ফর ওয়ান উইক। এ বছর এই ছুটিটাই বাড়িয়ে দেওয়া হল, অন্টারিও প্রিমিয়ার অ্যানাউন্স করেছে স্কুল এপ্রিলের ৫ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। স্টুডেন্টসরা যেন ডিসট্যান্স লার্নিংয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে। স্কুল এখনও খোলেনি, দেড় মাস হয়ে গেল, আমার মেয়ে এখন ভার্চুয়াল ক্লাসরুম অ্যাটেন্ড করছে, মনে হয় না এ বছর আর স্কুল খুলবে। মেয়ের ডান্স অ্যান্ড টিউশন ক্লাসও অনলাইন হচ্ছে।
মেয়ে স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি তাড়াহুড়ো করে সুপারমার্কেট গেলাম প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে কারণ তখন জানতাম না গ্রসারি স্টোরগুলো খোলা থাকবে কি না। সে দিন সুপারমার্কেটে প্রচুর ভিড় লক্ষ্য করলাম। সবার ভেতরে প্রয়োজনীয় জিনিস জমা করার প্রবণতা দেখা গেল। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মার্কেট থেকে গ্লোবালি আউট সঙ্গে টয়লেট পেপারও পাওয়া গেল না। সবাই এখানকার ভারতীয় দোকান থেকে প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, আটা কিনে রাখছে। আমিও প্রয়োজন মতো সংগ্রহ করে রাখলাম। অনেকেই প্রথম দিকে প্যানিক বায়িং করছিলেন এখন সেটা খানিক বন্ধ হয়েছে।
হাজব্যান্ড রাতে ফিরল, যতটা সম্ভব স্যানিটাইজড হয়ে। আমরা এখন ঘর থেকে কাজ করছি। একই বাড়িতে কিন্তু ৯ – ৬ আমরা কেউ কারও সাথে দেখা করার সুযোগ পাই না। কারণ যে যার রুমে ডোর লক্ড করে কাজ করি। আমার মেয়ে অবশ্য মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা করে, আমি ওকে হোমওয়ার্ক দিয়ে নিজের কাজ করি।
আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা বন্ধ -আমার ইন্ডিয়া যাওয়া আর হল না। মা কলকাতায় একা পড়ে আছেন, পরিচারিকাবিহীন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রীর করোনা পজিটিভ ধরা পড়ার পর ১৪ দিন তিনি গৃহবন্দি থাকেন। তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও গৃহবন্দি ছিলেন স্বেচ্ছায়।
প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি সম্পর্ক জনগণকে সচেতন করতে রোজ সকালবেলা বক্তব্য রাখছেন. তাঁর সঙ্গে প্রত্যেকটি প্রভিন্সের প্রধানরাও প্রতি দিন বক্তব্য রাখছেন। এই রোগ মোকাবিলায় একশো কোটি ডলার মঞ্জুর করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সরকার থেকে সব রকম পদক্ষেপ করা হচ্ছে যাতে সমস্ত মানুষের পাশে থাকা যায় এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। ব্যাঙ্ক মান্থলি মর্টগেজ কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে ইন্টারেস্ট রেটও অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাস করতে শুরু করেছে সারা পৃথিবীকে। কানাডাও তার বাইরে নয়। বহু মানুষ পেশাহীন হয়ে পড়েছেন, যাঁরা জীবিকা হারাচ্ছেন বা করোনা সঙ্কটের কারণে কাজ করতে পারছেন না, সরকার থেকে তাঁদের অর্থসাহায্য করা হচ্ছে। এই সময় ভাড়া না পেলে ভাড়াটেদের যাতে বাড়ির মালিকরা উচ্ছেদ করতে না পারেন সে দিকটাও নজর রাখা হচ্ছে। অন্তত এই বিপদের সময় লোকজনের মাথার উপর থেকে ছাদ যাতে চলে না যায় সেটা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য।
এই পরিস্থিতিতে মাস্ক-ই অন্যতম বাঁচার উপায়। এক বার যেটুকু না বেরোলেই নয়, তার বেশি আমরা বেরচ্ছি না। জানি সারা ক্ষণ ঘরের মধ্যে থাকতে ভাল লাগে না, আমরা বাড়ির চার পাশের এলাকায় একা একা হাঁটতে বেরচ্ছি। কারণ তাতে ফিজিক্যাল আর মেন্টাল হেলথ দু’টোই ভালো থাকে। অনেকেই আবার তাদের পোষ্যকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বেরচ্ছে। মুদিখানার দোকানে একসাথে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতা ঢুকতে পারছেন। বাকিদের বাইরে ১০ ফুট দূরত্ব রেখে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আমার প্রায় ১২ বছরের নর্থ আমেরিকান অভিজ্ঞতায় এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। কানাডার সরকার অনেক আগে থেকেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন।
শপিং মলে অভাব নেই জিনিসপত্রের। ছবি-লেখিকা।
এখানে রেস্তরাঁগুলো খোলা আছে। তবে শুধু হোম ডেলিভারির জন্য। অন্টারিওতে সমস্ত নন-ইমার্জেন্সি বিজনেস ৪ মে পর্যন্ত বন্ধ। এখন সরকার আলোচনা শুরু করেছেন কী ভাবে ধাপে ধাপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়। বসন্ত ও গ্রীষ্মের সমস্ত উৎসব বাতিল করা হয়েছে ৩১ অগস্ট পর্যন্ত। স্কুল এবং ইউনিভার্সিটি র সমস্ত ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে। কানাডা এবং আমেরিকার বর্ডার বন্ধ রাখা হয়েছে ট্রুডো ও ট্রাম্পের পারস্পরিক চুক্তিতে।
হাসপাতালগুলোতে বাইরে টেন্ট খাটিয়ে ড্রাইভ থ্রু র্যাপিড করোনা ভাইরাস টেস্ট সেন্টার খোলা হয়েছে। লং টার্ম কেয়ার হোম ডেথ রেট খুব বেশি।
কানাডিয়ান অথবা অভিবাসী, যাঁরাই এমার্জেন্সি ফান্ডে আবেদন করবেন, তাঁরা যোগ্য হোন বা না হোন, সরকার তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। পরের বার ট্যাক্স রিটার্নের সময় যোগ্যতা নির্ধারণ হবে। সমস্ত পাবলিক স্কুলের স্টুডেন্টরা অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন ডিসট্যান্স লার্নিং-এ টেকনোলজি ইকুইপ্ড হওয়ার জন্য। মানে, স্টুডেন্টসরা যেন ইন্টারনেট সমেত ল্যাপটপ অথবা ট্যাব কিনতে পারেন।
সমস্ত পার্ক, অ্যাকটিভিটি অ্যান্ড কমিউনিটি সেন্টার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। আমাদের এখানে বাঙালি কমিউনিটির বসন্ত উৎসবের জন্য রিহার্সাল চলছিল। সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবুও বাঙালিদের উৎসাহে ভাটা পরেনি। তাঁরা অনলাইনে গান, নাচ, আবৃত্তি করে উইকএন্ডে ভার্চুয়াল আমোদপ্রমোদে নিজেদের লিপ্ত রেখেছেন। অনলাইনে জিনিসপত্র ডেলিভারি পেতে ২-৩ উইক লেগে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কার্ব সাইড পিকআপ করে নিয়ে আসা হচ্ছে। অনলাইনে অর্ডার করলে কনফার্মেশন নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে এবং নিৰ্ধারিত টাইমে কার্ব সাইড পিকআপ জোনে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়াতে হবে। অর্ডার নম্বর অনুযায়ী ওই দোকানের লোক এসে অর্ডারমাফিক জিনিস গাড়িতে তুলে দিয়ে যাবেন। গাড়ি থেকে নামতে হবে না। কন্টাক্ট লেস শপিং এক্সপেরিয়েন্স।
এই সঙ্কটের সময়ে মা, দিদি এবং আত্মীয়-বন্ধুদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। আমার দিদি নিউ জার্সিতে থাকেন। ওখানে যে মৃত্যু-মিছিল চলছে! কানাডা থেকে আমেরিকায় বেড়াতে যাওয়ার উপর অনির্দিষ্ট কালের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকা। আমাদের খুব কাছের এক জন বন্ধু আমেরিকায় থাকেন। চাকরি হারিয়েছেন। এখনও উনি বেকারভাতা পাননি। মাথার উপর পাহাড়প্রমাণ ক্রেডিট কার্ডের বিল। পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী বা ত্রাণ না পেয়ে অনেকেই আত্মহত্য র রাস্তা বেছে নিচ্ছেন।
৬ মাস হল বাবা চলে গিয়েছেন। চলে যাওয়ার আগে আমাদের দুই বোনকে মানসিক ভাবে শক্ত হওয়ার জন্য শিখিয়েছিলেন।
Oh, deep in my heart
I do believe
We shall overcome, some day
….
We shall all be free, some day.
ঋতুপর্ণা বেরা, টরন্টো, কানাডা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy