লকডাউনে সুনসান ব্রিটেনের রাস্তা।
আমরা থাকি লন্ডন থেকে ৮০ মাইল দূরের একটা শহর পিটারবরো-তে। দিনটা ছিল ২ মার্চ। ইস্টারের ছুটিতে ইউরোপ ট্রিপে যাব বলে ভিসা করতে লন্ডন যাব দু’দিন পর। ইটালিতে তখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে করোনা। ব্রিটেনে দিনে ১০ থেকে ২০টা করে পজিটিভ রিপোর্ট আসছে। ব্রিটেন সরকার তখনও বলছে, এখানে সংক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করার মতো কিছু প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিলে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম বলেই খবর তখন। যদিও কোনও মেডিক্যাল স্টোরে মাস্ক পেলাম না। বলা হল, পুরো দেশে কোথাও মাস্ক নেই। মাস্কের আমদানি পুরোটাই চিন থেকে হয় এ দেশে। সুপার মার্কেটগুলোতে তখনই শেষ হয়ে গিয়েছে স্যানিটাইজার।
লন্ডন তখনও তেমনই প্রাণবন্ত। দেশ থেকে আনা একটা পলিউশন মাস্ককে অগতির গতি বানিয়ে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমি। রাস্তায় বা টিউবে লোকজনের বিস্ময়মাখা ভয়ের চাহনি দেখে নিজেরই সংশয় হচ্ছিল, আমরা কি অতি সাবধানী, নাকি এঁরা অতিমাত্রায় ভাবলেশহীন?
যাই হোক, সরকারের মানসিকতাও এঁদের মতোই উদাসীন তখনও। সরকারের চার ধাপে ভাগ করা ‘ব্রিটেন কোভিড রেসপন্স প্ল্যান’-এর প্রথম ধাপ কন্টেনমেন্ট অর্থাৎ দেশের প্রথম আক্রান্তদের চিহ্নিতকরণ ও কন্টাক্ট ট্রেসিং চলছে তখনও। যদিও এয়ারপোর্টগুলিতে হচ্ছে না ন্যূনতম চেকিং। চলছে না কোনও স্ক্রিনিং টেস্ট। চিন, ইটালি-সহ অন্যান্য দেশ থেকে আকাশপথ-সহ অন্যান্য পথে চলছে অবাধ যাতায়াত।
এর পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে। দিনে ৩০ থেকে ৫০০ করোনা আক্রান্তের খবর আসতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯-কে বিশ্ব অতিমারি ঘোষণা করে। ব্রিটেনও তাদের দ্বিতীয় ধাপ ‘ডিলে ফেজ’ ঘোষণা করে। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত যদিও তখনও পুরোমাত্রায় খোলা। সরকার জোর দেয়, ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরির উপর। অর্থাৎ একটা জনগোষ্ঠীকে এই ভাইরাসের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে ওই ভাইরাসের সঙ্গে লড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি মানবশরীরে তৈরি হয় কি না, সেটা দেখার পরীক্ষা। নতুন কোনও ওষুধ তৈরির সময় যেটা ইঁদুর বা গিনিপিগের সঙ্গে করার হয় আর কি।
ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী জানালেন, এ বার বাড়ি থেকে কাজ করা যেতে পারে। স্কুল বন্ধ হয়েছে তারও পরে, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে।
এর পর দ্রুত বদলে যেতে শুরু করল শহরের রূপ। ‘প্যানিক বাইং’ শুরু হল। খালি হতে থাকল সুপারমার্কেট। ভদ্র, বিনম্র ব্রিটিশ জাতি নিজেদের মধ্যে বা বিভিন্ন স্টোর কর্মচারিদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু করল খাবার বা টয়লেট পেপার কেনা নিয়ে। রাস্তাঘাট খালি হতে শুরু করল। শুরু হল অ্যাম্বুল্যান্স আর পুলিশের গাড়ির সাইরেনে। আক্রান্ত হলেন প্রিন্স চার্লস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্যসচিব ম্যাট হ্যানকক।
ব্রিটেনের অধিকাংশ সুপারমার্কেটেরই এমন অবস্থা। জিনিসপত্র নেই।
ইতিমধ্যেই সামনে এল আরও ভয়াবহ কিছু তথ্য। জানা গেল, এনএইচএস-এর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিপুল অপ্রতুলতার কথা। সরকারের নির্দেশিকা এল, বয়স্ক এবং সংক্রমণমুক্ত মানুষদের ঘরবন্দি করার জন্য। এল উপসর্গ দেখা দিলে নিকটবর্তী এনএইএস-এ ফোন করে দরকারি নিয়মাবলী জেনে নিয়ে নিজেকে কোয়রান্টিন করে রাখার নির্দেশ। এই রকমই একটি ভয়ঙ্কর তথ্য হল বার্মিংহামে এয়ারপোর্টের কাছে ১২ হাজার মৃতদেহ রাখার মর্গ তৈরি হয়েছে, যখন দেশে এক হাজার জনের মতো কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত।
লকডাউন হয়েছে সর্বত্রই। এরই মধ্যে ব্রিটেন সরকার আশঙ্কা করছে গুড ফ্রাইডে এবং ইস্টারের সপ্তাহে হয়তো মানুষজনকে ঘরে আটকে রাখা সম্ভব হবে না। পুলিশ মোতায়েন হয়েছে রাস্তার রাস্তায়। এনএইচএস-কে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে, ইস্টারের সপ্তাহে দৈনিক প্রায় ১০ হাজার সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনের কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে, যেখানে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৮ হাজার মানুষের এবং সেরে উঠেছেন মাত্র ১৩৫ জন।
এই অবস্থায় অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। সংক্রমণের এই বিভীষিকাময় রূপ কি ব্রিটেনের মতো ছ’কোটি জনসংখ্যার দেশে এড়ানো যেত না? যেখানে চোখের সামনে ইটালি, স্পেন বা ইরানের উদাহরণ ছিল। মৃত্যুর হার এত বেশি কেন? এনএইচএস কি উপযুক্ত নয় কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য?
দিন গুণতে গুণতে আজ ইস্টার উপস্থিত। সব কিছুর মতো ইউরোপ ট্রিপও বাতিল। চারপাশে সবার মতো আমরাও অসহায়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ— সব যেন এই ভাইরাসের চক্রব্যুহে আটকে গিয়েছে, বেরনোর পথ জানা নেই।
এই পরিস্থিতিতে বারবার চোখ চলে যায় নিজের দেশের খবরে। মনে পড়ে যায় নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কথা। কবে আবার সবাইকে দেখতে পাব জানি না।
প্রার্থনা শুধু একটাই— আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই ভুলগুলো থেকে যেন শিক্ষা নেয় আমার দেশ, কয়েকদিনের অসতর্কতায় যেন শেষ না হয়ে আমাদের সম্ভাবনাময় দেশের ভবিষ্যৎ। হয়তো কিছুটা সময় এখনও আছে আমাদের হাতে। আমরা হয়তো সবাই মিলে এখনও করোনাকে হারিয়ে দিতে পারি।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy