সপরিবারে অনিন্দ্য রায়। চিনের তিয়ানজিনে।
‘বাবু, গ্রাম থেকে কাউকে বেরতে দিচ্ছে না। কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছে না।’
পচার ফোনটা পেয়েই বুঝতে পারলাম ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। চিনা নিউ ইয়ারের ছুটি শুরু হয় ২৪ জানুয়ারি থেকে। তার আগের দিনই সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম পচার বাবার বাড়িতে। তিয়ানজিন শহরের এক পাশের একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট এরিয়ার যেখানে আমরা থাকি, সেখান থেকে কম-বেশি ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভ। আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়ে বেরনোর সময় পচা জানিয়ে দিয়েছিল, আমরা যেন মাস্ক পরে বেরোই। সেই মতো মাস্কে মুখ ঢেকে আমি, মা আর দিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। পচাকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে সোজা হাইওয়ে। পচার গ্রামের ঠিক আগেই একটা ছোট শহুরে জনপদ আছে। সেখানে একটা সুপারমার্কেটে গেলাম। নিউ ইয়ারের উৎসবের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে। বাড়ির জন্য আর পচার ভাইঝিদের জন্য। সুপারমার্কেটে গিয়ে চোখ ছানাবড়া! সবাই মাস্ক পরে ঘুরছে।
আমার স্ত্রীর নাম জ্যাং ইং, আমি তাকে পচা বলে ডাকি। আমার মেয়ের নাম জ্যাং দিয়া। আমার নাম অনিন্দ্য। আমার মা ও স্ত্রী আমাকে বাবু বলে ডাকে। আমার স্ত্রী ও মেয়ে চিনের নাগরিক। আমি এখানে ১২ বছর ধরে কর্মসূত্রে রয়েছি। আদতে কলকাতার সরশুনার বাসিন্দা।
তো, আমরা পচার বাড়িতে যাই। অন্য সময়ে গেলে যা যা হয়, সেই এক সঙ্গে রাতের খাবার খাওয়া, পরের দিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় বাজারে গিয়ে ব্রেকফাস্ট, এই বারও হল। মাস্ক পরে যদিও। সারা দিন মোমো বানিয়ে রাত বারোটায় মোমো খাওয়া। সব কিছুই স্বাভাবিক। ২৫ জানুয়ারি, মধ্যাহ্নভোজের পর আমার আর মায়ের ফিরে আসার কথা ছিল। পচা আর দিয়া থাকবে আরও দু’দিন। খারাপ খবর তখন সবে আসতে শুরু করেছে। ২৩ তারিখ থেকেই উহানে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আমি যদিও কোনও খবর পাচ্ছি না। চিনা ভাষা আমি পড়তে পারি না। আর ভারতীয় সংবাদপত্রে একটা- দু’টো ব্যাখ্যা ছাড়া বিস্তারিত কিছুই নেই। বেরনোর সময় পচা পইপই করে বলে দিল, বাইরে যেন না বেরই। মল, সুপারমার্কেট, কোথাও না। রাস্তাঘাট তখনও স্বাভাবিক। বাস, ট্যাক্সি চলছে। ছুটি বলে একটু কম। কিন্তু লোকচলাচল স্বাভাবিকই।
তার পরের এক মাস আমরা কাটালাম সম্পূর্ণ ঘরবন্দি হয়ে। পচারা ফিরল এক দিন পর। পচার দাদা ওদের দিয়ে গেলেন মাঝামাঝি একটা জায়গায়। আমি সেখান থেকে নিয়ে এলাম। যখন দেখছি ইউরোপ, আমেরিকার সুপারমার্কেটগুলো ফাঁকা ফাঁকা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না, সুপারমার্কেটের সামনে লম্বা লাইন, জিনিসপত্রের চড়া দাম, এর কোনওটাই এক মুহূর্তের জন্য আমরা ‘ফেস’ করিনি। কোনও দিন কোনও কিছুর অভাব বা মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে দেখিনি। সব সুপারমার্কেট খোলা ছিল। চালু ছিল হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। অনলাইন শপিং তো ছিলই। হাউজিং কমপ্লেক্সের ভিতরের দোকানগুলোও খোলা ছিল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, সপ্তাহের সাত দিনই। স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থা সচল ছিল। মেট্রো, ট্রেন সব চলেছে নিয়ম মেনে। এমনকী, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলা একমাত্র রুটের বাসটাও, যেটায় যাত্রী প্রায় থাকে না বললেই চলে, সেটাও চলেছে নিয়ম মেনেই। কোনও যাত্রী না থাকা সত্ত্বেও।
সব কিছু খোলা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ কিন্তু নিজেদের দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। যদিও ট্রেন, বাস চালু থাকা সত্ত্বেও লোকজন বাড়ি থেকে বেরোননি। সুপারমার্কেট খোলা থাকা সত্ত্বেও কেউ ভিড় জমাননি সেখানে। এমনকী, হাউজিং কমপ্লেক্সের ভিতরের পার্ক, যেখানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কচিকাঁচাদের আনাগোনা লেগেই থাকে, সেখানেও কেউ যায়নি। তবে এটাও সত্যি, চিনে ৯০ শতাংশ লোক থাকেন ‘কমিউনিটি’ হিসেবে। হাউজিং কমপ্লেক্সের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টা করে বিল্ডিং আর অজস্র অ্যাপার্টমেন্ট। প্রত্যেকটা কমপ্লেক্সে রয়েছে ২৪ ঘন্টার পাহারাদার। শহরে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও একই ব্যবস্থা। তাই মানুষের মেলামেশা বা বাইরের লোকজনের আনাগোনা চিনে যে ভাবে বন্ধ করা সম্ভব, পৃথিবীর অন্য তা সম্ভব নয়। আমাদের ভারতে তো নয়ই। তাই আমাদের দেশে সংক্রমণের ভয়টা বেশি। সেটা এড়ানোর জন্য সাধারণ নাগরিকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন।
আশা করি, আমার দেশের সবাই এক সঙ্গে এই লড়াইটা লড়বেন। প্রত্যেকে নিজের নিজের ভূমিকাটা পালন করবেন। আর খুব শীঘ্রই আমরা এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাব।
অনিন্দ্য রায়, তিয়ানজিন, চিন
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy