হামবুর্গের ফাঁকা রাস্তা। ছবি: লেখকের নিজস্ব।
১২ এপ্রিল ইস্টার। এখানকার মানুষদের জন্য বসন্তের ছোঁয়া বয়ে নিয়ে আসবে এই উৎসব। প্রতিবছর এই দিনটিতে মেতে ওঠেন সারা দেশের মানুষ। সপ্তাহান্তের ছুটিতে কেউ পরিবার নিয়ে সমুদ্রতটের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন, কেউ কেউ আবার নিজের আদি বাড়িতে মা-বাবা, আত্মীয় পরিজনদের কাছে ফিরে যান। এইসময় প্রকৃতিও নিজেকে নতুন পাতায়, রঙিন ফুলে সাজিয়ে তোলে। কিন্তু এ বছর সবকিছুই আলাদা। নোভেল করোনার প্রকোপে বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো পরিস্থিতি এই মুহূর্তে নেই। তাই ঘর থেকেই রঙের বাহার দেখছি আমরা। সদ্য দু’সপ্তাহ কো। রান্টিনে কাটিয়ে আসা জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মর্কেলও সকলকে নিরাপদে থাকার বার্তা দিয়েছেন। জানিয়েছেন, এ বছর পরিবারকে দেওয়ার মতো উপহার একটাই, আর তা হল বাড়িতে সুরক্ষিত থাকা এবং যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা। আগামী দিনে ফের একসঙ্গে উৎসহে শামিল হওয়া যাবে, কিন্তু আজ সেই সময় নয়।
জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ১ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজারের বেশি মানুষ। আতঙ্কে গৃহবন্দি হয়ে রয়েছেন নাগরিকরা। নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে, একসঙ্গে এক পরিবারের দু’জনের বেশি রাস্তায় বেরোতে পারবেন না। যাঁরা বাইরে বেরোচ্ছেন, তাঁদের পরস্পরের থেকে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। রেস্তরাঁ, থিয়েটার-সহ আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অপরিহার্য নয় এমন সব পরিষেবাই। নিয়ম লঙ্ঘন করলে কয়েক’শ থেকে কয়েক হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। এখানে সম্পূর্ণ ভাবে লকডাউন ঘোষণা করা না হলেও, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। বয়স্ক মানুষের যেহেতু করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে কমবয়সীদের। এই সঙ্কটের সময় নিজে থেকে বয়স্কদের সাহায্য করতে এগিয়ে আশা লোকের কিন্তু অভাব নেই। এখানেই হয়ত মানবসভ্যতার উত্তরণের দুই মহামন্ত্র, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা লুকিয়ে রয়েছে।
আমি যে শহরে থাকি, সেই হামবুর্গে এই মুহূর্তে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩০০০। প্রাণ হারিয়েছেন ১৯ জন। রাস্তাঘাটে মানুষের আনাগোনা এখন খুবই কম। তবে প্রয়োজনীয় সব জিনিসের জোগান যোগান আছে। কিছুটা হলেও প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছেন মানুষ। তাই সুপারমার্কেটের তাকগুলো ফের ভরে উঠতে শুরু করেছে। সতর্ক হয়ে, নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্কে মুখ ঢেকে, হাতে গ্লাভস পরে সেখানে কেনাকাটা করছেন সাধারণ মানুষ। এখনও পর্যন্ত আমেরিকা-ইটালির তুলনায় জার্মানিতে মৃত্যুসংখ্যা কিছুটা কম। সেটা যাতে কমই রাখা যায়, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে জার্মান সরকার। তাতে সমান সহযোগিতা করছেন সামনে থেকে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীরা। কয়েকদিন আগে খবরে দেখলাম, অতিমারির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ২০০০ স্বাস্থ্যকর্মীই সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন। তাতে কিন্তু লড়াইটা থেমে যায়নি বরং ইটালি, স্পেনের মতো দেশগুলি থেকেও আক্রান্তদের এ দেশে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কের মধ্যে লক্ষাধিক টাকার মালপত্র চেটে দিলেন এক মহিলা
বাড়িতেই বসে থাকার জন্য দিনগুলো হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এইসময় আমাদের নতুন সেমেস্টার শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত সবকিছুই পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানকার সমস্ত অফিসই কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেথে। যদি কোনও ভাবে অফিস যেতেও হয়, সে ক্ষেত্রে একটা ঘরে একজনের বেশি বসে কাজ করা
আরও পড়ুন: বিহারের মোট করোনা আক্রান্তের এক তৃতীয়াংশ এক পরিবারের সদস্য
যাবে না বলে সাফ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে সমস্ত স্কুলও। ২০ এপ্রিলের পর পরিস্থিতি বুঝে অনলাইন ক্লাস শুরু করার চিন্তাভাবনাও চলছে। এখানে ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে নিজের খরচ চালান। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেরই আর চাকরি নেই। তাঁদের জন্য সরকার বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার চিন্তাভবনা করছে বলে জানানো হয়েছে আমাদের। এমনকি এইসময় যদি বাড়ি ভাড়া দিতে না পারি, সে ক্ষেত্রে ভাড়া মেটানোর জন্য বাড়তি সময় পাওয়া যাবে, যাতে এই দুঃসময়ে কারও মাথার উপর থেকে আশ্রয় না চলে যায়।
আজকাল সারা দিন বাড়িতেই কাটছে। এমন দিনও যাচ্ছে যেদিন জানলা থেকে মুখ বাড়ালেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একাকীত্ব কাটাতে নানা ভাবে নিজেদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। বাড়ির সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। ভারতেও যেহেতু ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে, তাই পরিবারের লোকজনের জন্য চিন্তা হচ্ছে। তবে জানতে পারলাম লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছি। কারণ ভারতের মতো জনঘনত্বের দেশে লকডাউনই বোধহয় এই সংক্রামক রোগকে প্রতিহত করার একমাত্র উপায়।
এখানে আমরা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরাও সবসময় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলেছি। যোগাযোগ রেখে চলেছি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গেও। যে কোনও পরিস্থিতিতে যাতে সাহায্য পাওয়া যায় , তার জন্য ভারতীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে হটলাইন নম্বর এবং ইমেল অ্যাড্রেস দেওয়া হয়েছে। বাড়ির লোকজন যাতে আমাদের জন্য চিন্তা না করেন, তার জন্য এখানকার দূতাবাস এবং সমস্ত স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আমাদের সাহায্য করে চলেছে। আমাদের মধ্যে কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হয়, আমরা যেন সঙ্গে সঙ্গে দূতাবাসকে সেটা জানাই, তা-ও বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতি দেখা দিলে কেউ যাতে একা না হয়ে পড়ে, আমরা নিজেরাও সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছি। গোটা বিশ্বে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত। চারিদিকে হাজার হাজার মনুষ মারা যাচ্ছেন। প্রতিদিনই মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় এইটুকুই যে বাড়িতে থেকে, সতর্ক থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। আমাদের জন্য যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, সবরকম ভাবে তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করা। এ ভাবেই আমাদের চেনা পৃথিবী আবার ফিরে আসবে। তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
নীরমেঘা মিশ্র
স্নাতকোত্তর ছাত্রী
হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy