শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর চিঠিতে (‘বড় মাপের নেতা’, ২৫-০৬) বলেছেন, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ তাঁর দিনলিপিতে লেখেন, তাঁর সঙ্গে সুভাষের কোনও ব্যক্তিগত বিরোধ নেই।’’ সুভাষচন্দ্র বসু যে ধরনের নেতা ছিলেন, তাতে তাঁর সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত বিরোধ না থাকারই কথা। বিরোধটা ছিল নীতিগত। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া উচিত। রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির দ্বারা। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থকে পরস্পরের পরিপন্থী বলে তিনি মনে করতেন না। বরং খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য-শিক্ষার অভাব প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ অভিন্ন বলে মনে করতেন।
সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় কংগ্রেস সদস্যদের হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের সদস্য হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কারণ ওই সংগঠনগুলি তখন আগের চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছিল। অন্য দিকে, শ্যামাপ্রসাদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু মানসিকতার ভিতরে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী চিন্তার অনুপ্রবেশ ও সেই চেতনাকে মুসলিম বিদ্বেষে পরিণত করা। সেটিকে তিনি রাজনৈতিক পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ফলে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর তীব্র নীতিগত বিরোধ বাধে।
সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের ক্ষতি করবে। ফলে শ্যামাপ্রসাদ এবং হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তিনি বিরোধিতা করেন। সেটা এতই আপসহীন ছিল যে, শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, ‘‘সুভাষচন্দ্র আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন, হিন্দু মহাসভা যদি বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন হিসবে মাথাচাড়া দিতে চায়, তবে সেটা জন্মের আগেই গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য হব, যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, তা হলে সেটাই করব।’’ শ্যামাপ্রসাদ তা হলে কী ভাবে বলতে পারেন সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধার সম্পর্ক?
ইন্দ্রজিৎ মিত্র
ঢাকুরিয়া, কলকাতা
কবির দুর্দশা
আমি নজরুল অনুরাগী। তথাগত রায় তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, ১৯৪২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম প্রচণ্ড আর্থিক ও শারীরিক দুর্দশায় পড়লে কবির ধার শোধ করে এবং মধুপুরে নিজেদের বাড়িতে রেখে তাঁর শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আমি এই কথার সমর্থনে তথ্য কোথাও খুঁজে পাইনি। নজরুলের অনেকগুলি জীবনীগ্রন্থ খুঁজে যা পেয়েছি তা হল, নজরুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে তাঁর বাক্রোধ হওয়ার পর নিজেই চিঠি লিখে জানান সুফি জুলফিকার হায়দারকে। হায়দার সাহেব সেই খবর দেন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক সাহেবকে।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন মন্ত্রিসভার সদস্য। হক সাহেব নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য শ্যামাপ্রসাদকে জানান। নজরুলের চিকিৎসা করছিলেন ডা. ডি এল সরকার। তিনিই নজরুলের পরিবারকে সম্মত করিয়েছিলেন মধুপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অর্থের অভাবে তাঁরা রওনা দিতে পারছিলেন না। এই সময়ে শ্যামাপ্রসাদ এসে দেখা করে পাঁচশো টাকা দেন। কৃতজ্ঞচিত্তে নজরুল তা গ্রহণ করেন। এই অর্থদানের কথা সকলেই স্বীকার করেন। মধুপুর থেকে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে শ্যামাপ্রসাদকে তিনি পত্রে লিখেছিলেন, ‘‘আরও পাঁচশ’ টাকা অনুগ্রহ করে যত শীঘ্র পারেন, পাঠিয়ে দেবেন বা যখন মধুপুরে আসবেন, নিয়ে আসবেন।’’ এই অর্থসাহায্য তিনি পেয়েছিলেন, এমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
মধুপুরের চিকিৎসায় ফল না পাওয়ায় দু’মাস পরেই নজরুলকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। নজরুলের মস্তিষ্কের যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে লুম্বিনী পার্ক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সংবাদপত্রে খবর বেরোলেও প্রায় কেউই তাঁকে দেখতে পর্যন্ত যাননি।
এর পর নজরুলকে বাড়িতে আনা হয়। বহু বিশিষ্ট মানুষকে নিয়ে ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, আর যুগ্ম-সম্পাদক সজনীকান্ত দাস ও সুফি জুলফিকার হায়দার। এই কমিটি থেকে পাঁচ মাস নজরুলের পরিবারকে দুশো টাকা করে সাহায্য পাঠানো হয়। পাঁচ মাস পরে কোনও এক কবি কমিটিকে জানান, সাহায্যের টাকায় নজরুলের পরিবারে আশ্রিতদের নিয়ে সকাল-বিকাল মন্ডা-মিঠাই খাওয়া হচ্ছে। কোনও অনুসন্ধান না করে কমিটি আচমকাই টাকা বন্ধ করে দেয়। ক্ষুব্ধচিত্তে সে দিন যুগ্ম সম্পাদক হায়দার সাহেব শ্যামাপ্রসাদের বাড়িতে গিয়ে টাকা বন্ধ করে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ সরাসরি বলেছিলেন, ‘‘না আর টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। যা শুনলাম, সাহায্য করার মতো ব্যাপারটা নয়। আগে জানতে পারলে তাও করতাম না।’’ সুতরাং তথাগতবাবুর কথাগুলির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মানস জানা
কী ছিল অবস্থান?
তথাগত রায় তাঁর চিঠিতে (‘স্থিরচিত্ত নন?’, ২৫-০৬) ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন ‘‘সেই সময় কংগ্রেস নেতারা সবাই জেলে এবং কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে ব্রিটিশের পদলেহনে ব্যস্ত।’’ ওই সময় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন চলছিল। এই আন্দোলন সম্পর্কে কী অবস্থান নিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়? তিনি ২৬ জুলাই, ১৯৪২-এ বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন আর্থার হারবার্টকে চিঠিতে লেখেন— ‘‘কংগ্রেস খুব শীঘ্রই যে ব্যাপক আন্দোলনের ডাক দিতে চলেছে এই যুদ্ধের সময়, তা প্রতিরোধের জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছি। যুদ্ধের জন্য হয়তো তা একটু সীমাবদ্ধ, কিন্তু জনসাধারণের ভোটেই তো আমরা মন্ত্রী হয়েছি। আমরা মন্ত্রীরা মানুষকে বোঝাব যে ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ভারতের জনসাধারণের স্বার্থেই আমাদের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে।’’
শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামেও যোগ দেননি। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার অন্যতম কর্মসূচি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে হিন্দু যুবকদের নাম লেখানো (, সুভাষচন্দ্র বসু, পৃ-১৯৯, আনন্দ, রচনা সংগ্রহ ২য় খণ্ড)।
শান্তনু দত্ত চৌধুরী
আত্মবিস্মৃত নয়
তথাগত রায় তাঁর চিঠিতে বাঙালিকে ‘আত্মবিস্মৃত জাতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন রামমোহন, তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঢেউ উঠেছিল নবজাগরণের। এই ঐতিহ্যে সঙ্কীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষের জায়গা ছিল না। এই ঐতিহ্যই বাংলাকে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সারা দেশের মধ্যে একটি বিশেষ জায়গা করে দিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতি ছিল এই ঐতিহ্য-বিরোধী। তা ছিল এক দিকে মুসলিম-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ, অন্য দিকে ব্রিটিশদের সঙ্গে অনেকটাই সহযোগিতামূলক। তাই ’৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যখন মাতঙ্গিনী হাজরা গুলিতে প্রাণ দিচ্ছেন, তমলুকে স্বাধীন সরকার গঠিত হচ্ছে, তখন শ্যামাপ্রসাদ এই আন্দোলনকে ‘অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা’ বলছেন এবং নিজেকে ও দলকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতে প্রবেশ করছে— এই সংবাদে যখন দেশজুড়ে প্রবল উত্তেজনা, তখন শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য হিন্দু যুবকদের আহ্বান করছেন। শ্যামাপ্রসাদকে বিস্মৃত চরিত্রে পরিণত করেই বাঙালি প্রমাণ করেছে যে তারা আত্মবিস্মৃত জাতি নয়।
শিলাই মণ্ডল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy