Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Balai Chand Mukhopadhyay

সম্পাদক সমীপেষু: বেজেছে বহুস্বর

বনফুল তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনসত্যকে যথার্থ মহিমায় প্রকাশ করেছেন তাঁর গল্পসমূহে। তিনি জানতেন ছোটগল্প বহুব্যক্তির বিচিত্র মুহূর্তের বহুনিষ্ঠ ভাবভাবনার উন্মেষ।

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৪ ০৬:২৫
Share: Save:

শুভাশিস চক্রবর্তীর ‘ডায়নোসরদের রাজত্বে দেখেছিলেন নেতাদের প্রাগৈতিহাসিক শক্তিতন্ত্র’ (রবিবাসরীয়, ২১-৭) শীর্ষক প্রবন্ধসূত্রে কিছু কথা। বৈচিত্রধর্মী বিস্ময়কর বহু রচনার স্রষ্টা ছিলেন বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন ব্যঙ্গাত্মক সরস দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। আখ্যানধর্মী সহজ সরল বর্ণনায় তাঁর ছিল ঋজু স্পষ্টতার ছাপ। মানবজীবনের বিস্তার ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন তাঁর সাহিত্যে। সেখানে মানবসত্তার জটিল বহুবর্ণময় বোধ উদ্ভাসিত হয়েছে তীক্ষ্ণ তির্যকতায়।

বনফুল তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনসত্যকে যথার্থ মহিমায় প্রকাশ করেছেন তাঁর গল্পসমূহে। তিনি জানতেন ছোটগল্প বহুব্যক্তির বিচিত্র মুহূর্তের বহুনিষ্ঠ ভাবভাবনার উন্মেষ। তাঁর গল্পে, “বেজেছে বহুস্বর কলকণ্ঠ।... (সেখানে) কারিগরির দিকে ঝোঁক নেই, ঝোঁক আছে আস্ত জীবনের দিকে, যে জীবন বহু-বিচিত্র বহু বিসর্পিত।... এঁর গল্প প্রচণ্ড, হয়তো স্থানে স্থানে মোলায়েম নয়, কিন্তু সর্বদা হৃদ্য এবং পরিতৃপ্তকর।” (বনফুল গল্প শতক, ভূমিকা, সুকুমার সেন)। তিনি লিখেছেন ‘ভোম্বলদা’, ‘অর্জুন মণ্ডল’, ‘ফুলদানীর একটি ফুল’-এর মতো জীবন-মহত্ত্বকে স্পর্শ করা গল্প। আবার তির্যকতা, ব্যঙ্গ ও চমকিত পরিসমাপ্তিতে উজ্জ্বল তাঁর ‘অমলা’, ‘অদ্বিতীয়া’, ‘বৈষ্ণব ও শাক্ত’, ‘দিবা দ্বিপ্রহরে’, ‘নিপুণিকা’ গল্পসমূহ। তবে নিছক কৌতুকময়তা নয়, জীবনবোধের গভীরতায় ঋদ্ধ ‘তিলোত্তমা’, ‘নিমগাছ’, ‘জাগ্রতদেবতা’ প্রভৃতি গল্প। প্রেম-মনস্তত্ত্ব ও মানবমনের দুর্গম রহস্যমোড়া গল্প হিসাবে ‘মানুষের মন’, ‘মানুষ’, ‘পাশাপাশি’, ‘মুহূর্তের মহিমা’, ‘ছেলেমেয়ে’ প্রভৃতি গল্প বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। তবে প্রেমের মহত্ত্ব প্রকাশে আজও উজ্জ্বল তাঁর ‘তাজমহল’, ‘শেষছবি’ গল্প। আর ‘গণেশজননী’ ও ‘ঐরাবত’ বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী সংযোজন।

বনফুল অত্যন্ত জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকও। তাঁর “রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা, আখ্যানবস্তু-সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনীশক্তি, তীক্ষ্ণ মননশীলতা ও নানারূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়া মানবচরিত্রের যাচাই পাঠকের বিস্ময় উৎপাদন করে” (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, ১৯৮৮)। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, মানবতাবোধই ছিল তাঁর ধর্ম। যার স্বচ্ছ ও স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে নির্মোক, হাটেবাজারে, অগ্নীশ্বর, উদয়-অস্ত প্রভৃতি উপন্যাসে। স্বকর্ম-নিষ্ঠ ডাক্তারই এ সব উপন্যাসের নায়ক। বনফুলের সৃষ্টির সার্থকতম নিদর্শন হল ডানা, স্থাবরজঙ্গমস্থাবর-এ আছে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষের কথা। আর জঙ্গম-এ আছে শহুরে জীবনের চাঞ্চল্যপূর্ণ অস্থির রূপ। সেই সঙ্গে প্রকৃতি-শাসিত মানুষের দুর্দশাতাড়িত ট্র্যাজেডি। আর কালস্রোতে ভাসমান তৃণখণ্ডের মতো অসহায় মানবজীবনের ছবি রয়েছে তৃণখণ্ড উপন্যাসে। স্বাধীনতা, দেশভাগ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে লেখা অগ্নি, মানদণ্ড, সপ্তর্ষি বনফুলের সামাজিক দায়িত্বের অঙ্গীকারকে মনে করায়।

নাট্যকার বনফুল নির্মুক্ত সত্যভাষী। গম্ভীর ট্র্যাজিক রসসিদ্ধ জীবনী-নাটক শ্রীমধুসূদনবিদ্যাসাগর ছাড়াও লিখেছিলেন বিবেকানন্দের জীবন নিয়ে নাটক শৃণ্বন্তু। যেখানে সমকালীন সমাজজীবনের আদর্শচ্যুতির বিষময় পরিণতির কথা ব্যক্ত হয়েছে। লিখেছিলেন অন্তরীক্ষে নামে রবীন্দ্র স্মরণে এক নাটক। একাঙ্ক নাটকও লিখেছিলেন। সামন্তপ্রথাভিত্তিক পুরুষশাসিত সমাজে নারীপীড়নের চিত্র পরিবেশিত শিক-কাবাব হল বহু পরিচিত উচ্চাঙ্গের নাটক। স্বাধীনতা-উত্তরকালীন সমাজচিত্র উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তিনি আসন্ন নাটকের ভূমিকায় বলেছেন, “স্বাধীনতা পাওয়ার পর যে-সব দুর্নীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বিষাক্ত করেছে, উত্তেজিত করেছে, বিপদে চালিত করেছে, সে-সব দুর্নীতি উন্মূলিত না হ’লে আমাদের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ বিপন্ন।” এই কথাগুলি পড়ে প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলা যায়, বনফুলের নাটকগুলির প্রাসঙ্গিকতা এই মূল্যবোধহীন সময়ে আরও বেড়েছে।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

দাদামশাই

‘রবিবাসরীয়’-তে শুভাশিস চক্রবর্তীর বনফুল সম্পর্কিত প্রবন্ধ সূত্রে এই চিঠির অবতারণা। বনফুলের সরস দৃষ্টি-মনের যে সন্ধান প্রবন্ধকার দিয়েছেন, সেখানে প্রাসঙ্গিক ভাবেই উল্লেখ্য যে, তাঁর সেই মৌলিক রসচেতনার সুযোগ্য পূর্বসূরি ছিলেন বাংলার সর্বজনশ্রদ্ধেয় রস-সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৩-১৯৪৯)। বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তিনি ‘দাদামশাই’ নামেই সুখ্যাত। জন্ম দক্ষিণেশ্বরে হলেও পরিবার, চাকরি ইত্যাদি কারণে কেদারনাথ প্রবাসী বাঙালিই ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জীবনের অর্ধশতক পার করে পাকাপাকি ভাবে লিখতে শুরু করেন। প্রথমে কাশী, পরে পূর্ণিয়ায় ছিলেন কেদারনাথ। সেই পূর্ণিয়াতেই বলাইচাঁদের বাবা ডাক্তার সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেদারবাবুর আলাপ। এক দিন বলাইকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন সত্যচরণের কাছে। বাবার আদেশ মেনে বলাই গেলেন দাদামশাইয়ের কাছে। উভয়কে দেখে মুগ্ধ উভয়েই। বয়সের বেড়া ডিঙিয়ে রসের আলাপ চলল নিরবচ্ছিন্ন ধারায়। প্রিয় বলাইচাঁদের শ্রীমধুসূদন, বিদ্যাসাগর নাটক পড়ে প্রীত-আপ্লুত হলেন দাদামশাই কেদারনাথ। সে কথাই লিখলেন চিঠিতে (২৪-১-১৯৩৮)। সঙ্গে বলে দিলেন: “ছোট গল্পই সাহিত্য জগতে তোমাকে বড় করবে।” কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অন্য দিকে, কুমারেশ ঘোষ সম্পাদিত যষ্টিমধু-র ‘দাদামশাই শতবার্ষিকী’ সংখ্যায় (বৈশাখ, ১৩৭১) বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ‘দাদামশাই’ প্রবন্ধে লিখেছেন “দাদামশায়ের চেষ্টাতেই আমার প্রথম বই ‘বনফুলের গল্প’ প্রকাশিত হয়।” সুতরাং বোঝাই যায়, দাদামশাই কেদারনাথ কতখানি স্নেহ করতেন দৌহিত্রপ্রতিম বলাইচাঁদকে। বেশ কয়েকটি চমৎকার চিঠি কেদারনাথ লিখেছিলেন বলাইচাঁদকে, ব্যক্তি প্রসঙ্গ ছাপিয়ে সেখানে বার বার উঠে এসেছে সাহিত্য, বাংলা, বাঙালির কথা। পক্ষান্তরে প্রিয় বলাই আজীবন মিতবাক, নম্র নত, শুদ্ধচিত্ত, আড়ম্বরহীন দাদামশাইয়ের উদ্দেশে হৃদয়ের পাত্র উজাড় করে লিখেছেন: “এ উৎসব-সভাতলে তাহারেই আজি নমিলাম/ ভারত-প্রতীক-পদে হৃদয়ের অর্ঘ্য সঁপিলাম।”

এমন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, প্রীতি আজকের দিনে দুর্লভ। বাংলা-বাঙালি আজ ক্রমশ দূরবর্তী তার অমূল্য ঐতিহ্যের থেকে। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়তো কিছু হবেই, কেননা আর কিছু হোক না হোক, তিনি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। আর তাঁর প্রিয় দাদামশাই ১৬০তম জন্মবার্ষিকীতেও অপাঙ্‌ক্তেয়। কারণ, তিনি পাঠ্যসূচিতেও নেই। বাঙালি আজ প্রতি দিন এ ভাবেই নিজের ঐতিহ্য নাশের ধারাবাহিকতা তৈরি করে চলেছে।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তরপাড়া, হুগলি

গুণমুগ্ধ

লেখক বনফুল সম্বন্ধে রম্যরচনাটি পড়লাম। আমার সামান্য সংযোজন। ছোট গল্পে তিনি ছিলেন মাস্টার মাইন্ড। পোস্টকার্ডের দু’পিঠ মিলিয়ে একটি সুন্দর গল্প উপহার দিতে পারতেন পাঠককুলকে। তাঁকে এক জন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, কোন পুরস্কার পেয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন। বনফুল বলেন— পূর্ণিয়া থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা যাব। ঘর থেকে বার হতে দেরি হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে দেখি ট্রেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছে। হঠাৎ দেখি ট্রেনটা আবার পিছিয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। ড্রাইভার সাহেব চিৎকার করে বলল, তাড়াতাড়ি হেঁটে আসুন। আপনাকে নিয়ে ট্রেন ছাড়বে। ড্রাইভার ছিল আমার লেখার গুণমুগ্ধ পাঠক। ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের (অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়) ‘রান্নাতেও বনফুলের হাত ছিল চমৎকার’ শীর্ষক প্রবন্ধেও এই ঘটনার উল্লেখ আছে।

সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

অন্য বিষয়গুলি:

Short Stories Bengali Novelist Bengali Writer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy