কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণের প্রথম বার্ষিকীতে দীপেশ চক্রবর্তী কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যে প্রবন্ধটি (‘আজীবন সত্যানুসন্ধানী’, ২০-৪) লিখছেন, তা পাঠ করে সঠিক ভাবে অনুধাবন করা গেল যে, সত্যিই ক্ষয়িষ্ণু বর্তমানে দাঁড়িয়েও বেঁধে বেঁধে থাকার মন্ত্রটুকুই ভরসা। কোনও রাজনৈতিক দলের বা তার কোনও গ্রুপের অনুগামী না হয়েও কবি শঙ্খ ঘোষের যে সত্য অনুসন্ধান, তার জুড়ি মেলা এই যুগে অসম্ভব। সত্যিই কবির কলমের এই ঝলসে ওঠা কবিতার আস্বাদ প্রকৃত মানবতার এক নির্ভেজাল নজির হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু হতাশা বা নিরাশার বাণীর চিত্র অঙ্কন এই রবীন্দ্র সাহিত্য অনুরাগীর একমাত্র অবলম্বন ছিল না। একটা ইতিবাচক প্রত্যয়ের বলিষ্ঠ অঙ্গীকারের চেতনার ফসল কবির কবিতা। এখানে শ্লেষের মধ্যে নেই কোনও ব্যঙ্গের চাবুক। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, তাঁর মননে ছিল না নিষ্ঠুরতার লেশমাত্র পরশ। এই সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে কবি জীবনবিমুখ কর্মবিমুখ পলাতক হয়ে গালভরা উপদেশ দিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে প্রয়াসী হননি। তিনি ছিলেন আমাদের চেতনা আর চৈতন্যের জাগ্রত বিবেক। তাঁর মৃত্যুতে তাই আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।
প্রবন্ধকার জানিয়েছেন যে, দৈনন্দিনের বাইরে গিয়ে শব্দ খোঁজার তাগিদ কবি শঙ্খ ঘোষের ছিল না। এই প্রসঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কায়দায় অভিধান ঘেঁটে শব্দ চয়নের কথা বলেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন সাহিত্যিক মহাকাব্য রচনা করেছেন, তখন কিন্তু বাংলা শব্দভান্ডারে এত শব্দসম্ভার ছিল না, যা দিয়ে এই ধরনের কাব্য রচনা করা যায়। মহাকবির মহান কৃতিত্ব এই শব্দ চয়ন। তবে এটা প্রবন্ধকার খুব সুন্দর ভাবে বলতে পেরেছেন যে, তথ্যের সত্যই হোক, বা কবিতার ভাষার সত্য, তার প্রতি দায়বদ্ধ থাকাটা একান্তই জরুরি। কবি শঙ্খ ঘোষ সত্যিই ছিলেন আজীবন সত্য অনুসন্ধানী।
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা
বটগাছের ছায়া
দীপেশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধ মনে করিয়ে দিল, এক বছর হয়ে গেল কবি শঙ্খ ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু দলতন্ত্র, হিংসায় পরিপূর্ণ এই রাজ্যে আমরা তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠের অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। ১৯৩২ সালে অবিভক্ত বাংলার বরিশালের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করে, পুব বাংলার নরম জল-হাওয়ায় জীবনের প্রথম পনেরোটি বসন্ত কাটিয়ে, দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে তাঁকে চলে আসতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর কবিতার কাঠামো তাই মায়াময়তার মোড়কে মোড়া থাকলেও রয়েছে ঋজু প্রতিবাদীর স্পষ্ট উচ্চারণ। অভিভাবকসম কবি যেন সব পিতার প্রতিভূ হয়ে ‘বাবরের প্রার্থনা’য় বলেন, “এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম/ আজ বসন্তের শূন্য হাত—/ ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।” আবার বিভাজনের দহনে দগ্ধ কবি ‘ফুলবাজার’ কবিতায় লিখলেন, “পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার ওপার/ রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?”
ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন কবি তাঁর গদ্য রচনায়, তাঁর কবিতায় শাসকের অত্যাচারের প্রতিবাদে শাণিত কলমের আঁচড় কেটেছেন। তাঁর রবীন্দ্রচর্চা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। সারা জীবন তিনি নিজের শর্তে বেঁচেছেন। বামমনস্ক হওয়া সত্ত্বেও বাম শাসনের মধ্যগগনে ১৯৯০ সালে কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে বক্তৃতায় তিনি বলেন, “প্রতাপ মত্ততা এবং প্রতাপ অন্ধতা যে কোনও সরকারের পক্ষে সর্বনাশের সূচক।” নন্দীগ্রামের গণহত্যার বিরুদ্ধে সমস্ত রকম রাজনৈতিক নেতানেত্রীকে অস্বীকার করে নাগরিক সমাজের মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার চার বছর পর ১৯৫১ সালের ২১ এপ্রিল কোচবিহারে ভুখা মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করেছিল কিশোরী বন্দনা তালুকদারকে। কাগজে সেই খবর পড়ে কবি লিখলেন মর্মস্পর্শী ‘যমুনাবতী’ কবিতা, “নিভন্ত এই চুল্লীতে মা একটু আগুন দে, আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে।” কী আশ্চর্য সমাপতন! সেই ২১ এপ্রিলে হারালাম আমাদের বিবেককে, আমাদের প্রিয় কবিকে। জরুরি অবস্থায় ‘রাধাচূড়া’ কবিতায় লিখলেন, “খুব যদি বাড় বেড়ে ওঠে, দাও ছেঁটে সব মাথা”। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দলের একতরফা ভোট লুটের প্রেক্ষিতে ব্যঙ্গ করে লিখলেন, “দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন, রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।” গুজরাত দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন ‘দুর্যোধন’ কবিতা, “নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।” এনআরসি, সিএএ-র প্রতিবাদে লেখা ‘মাটি’ কবিতাটিতে যেন আমাদের প্রাণের কথা লেখা আছে। বিভক্ত পুব বাংলায় ছোটবেলা কাটিয়ে, উৎখাত হয়ে এ বাংলার মাটি জল হাওয়ায় বড় হয়েছি, জীবন কাটিয়েছি, এ মাটিকেই তো আপন জানি। তাই তাঁর সঙ্গে উচ্চারণ করি, “আমারই হাতের স্নেহে ফুটেছিল এই গন্ধরাজ/ যে-কোনো ঘাসের গায়ে আমারই পায়ের স্মৃতি ছিল/... দুধারে তাকিয়ে দেখো, ভেঙে আছে সবগুলি সাঁকো/ কোনখানে যাব আর যদি আজ চলে যেতে বলো।”
কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণে তাই যেন বটগাছের ছায়া সরে গিয়েছিল, ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল তাঁর অনুগামী একলব্যদের হৃদয়। তবু আজও বাঙালি মঙ্গলশঙ্খের অনুরণন শোনে, শিরদাঁড়াটা সোজা করে দাঁড়ানোর প্রেরণা পায়।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
অভিভাবক
শম্ভু মিত্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “...আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে সকালে ঘুম ভাঙা থেকে আরম্ভ করে আর রাত্তিরে শুতে যাওয়া অবধি কেবলই কত বাজে কথা বলি, কত মিথ্যা ভাব প্রকাশ করি। যেটা অনুভব করছি না সেটাই বানিয়ে বলি, আর যেটা অনুভব করছি সেটা বলি না, চেপে রাখি।...এই রকম মিথ্যাচরণ যে মুহুর্মুহু করি সেটা বুঝতে পারা, সেটার সম্পর্কে তীব্র ভাবে সচেতন হওয়া এবং কষ্ট পাওয়া হল শিল্পী হওয়ার পথে বোধ হয় প্রথম ধাপ এবং যে যত বড় কলাশিল্পী সে বোধ হয় তত তীব্র ভাবে কষ্ট পায়। ...তখন মনে হবে যে এই মিথ্যাচরণে অভ্যস্ত মুখ নিয়ে, এই মিথ্যাকথনে অভ্যস্ত কণ্ঠস্বর নিয়ে আমি কী করে সেই সত্যকে প্রকাশ করব। আমাকে তো পরিচ্ছন্ন হতে হবে, নিজেকে তো সংস্কার করে শুদ্ধ করতে হবে।”
মৃদুভাষী, স্মিতহাস্যময় শঙ্খ ঘোষ সমাজ সচেতন শব্দশিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন-শুদ্ধ করে নিয়েছিলেন। দলাদলির বিধ্বস্ত সমাজে বার বার অভিভাবক হিসেবে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন। জীবনে রবীন্দ্রনাথের থেকে কী আমরা পেতে পারি, বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন— আমাদের দেখা যখন দৃষ্টি হয়ে ওঠে, তখনই সামনের ওই গম্যমান মানুষটি থেকে শুরু করে আবর্তমান সমস্ত সমাজভূমি পর্যন্ত সবটাই ভিন্ন আর সত্য এক রূপ নিয়ে জেগে উঠতে থাকে আমাদের সামনে। যে-দেখায় ‘ভোরের আলো নয়ন ভরে/ নিত্যকে পাই নূতন করে’, সেই একই দেখা সরিয়ে নিতে পারে এক জন সমাজকর্মীরও চোখের আবরণ (বিজয়ী সম্মিলন), দেশের আত্মাকে দেশের মধ্যে সত্য করে দেখতে পাই (সত্যের আহ্বান)।
আমরা যে ‘হাজার হাজার’ বাস্তবে খণ্ড খণ্ড করে একটার পর আর-একটাকে দেখে চলেছি (‘সত্যকে দেখা’) সেইখানে আমাদের ব্যর্থতা। শিল্প দিয়ে জীবন দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন দেখার সেই দৃষ্টি, দেশকালের মধ্যে রেখেও সব কিছুকেই দেশকালের বাইরে থেকে পাওয়া যায় যাতে। যখন বুঝতে পারি প্রতিটি মুহূর্তেই মৃত্যু, তখনই জীবনকে দেখতে পাওয়াটা নিজের মুঠোর মধ্যে ধরতে ইচ্ছে করে আরও। তবে, সে মুঠো আমার ব্যক্তিগত মুঠো নয়, সে এক জন আত্মগত মুঠো, সেই আত্ম, যে কেবলই আমাকে নিয়ে আসতে চায় দৈনন্দিন আমি-র বাইরে।
সত্যের নির্ভীক পূজারি হয়ে তিনি দলতন্ত্রের বাইরে থেকেও সমাজের সহিষ্ণু অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন।
সঞ্জয় রায়
দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy