Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
Creche Services

সম্পাদক সমীপেষু: কাজ ও সন্তান

মানব কল্যাণে, সংসারের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে, মেয়েদের চাকরির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ক্রমশ পরিবার ভেঙে যাওয়া, বা ছোট সংসার হওয়ার জন্য অনেক মেয়ের কাছেই শিশুর দেখাশোনা করা সমস্যা হয়ে যায়।

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৪ ০৭:২৬
Share: Save:

‘লালন-পালনের পরিষেবা’ (৬-৮) প্রবন্ধে স্বাতী ভট্টাচার্য চাকরিজীবী মহিলাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উপর আলোকপাত করেছেন। যে মহিলারা সংসারে আর্থিক সমস্যা মেটাবার জন্য কাজ করতে চান, সন্তান পালনের জন্য কাজের সময় বার করতে পারেন না, তাঁদের সকলেরই এই সমস্যা। শিশুসন্তান পালনের জন্য শ্বশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ির লোকজন, না হলে প্রতিবেশী, আয়া অথবা কাজের লোকের উপর নির্ভর করতে হয়। এ সব ক্ষেত্রে অনেক সময় শিশুর যৌন হেনস্থা, অপুষ্টি ও শিশু চুরির মতো ঘটনা ঘটে যায়। মানব কল্যাণে, সংসারের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে, মেয়েদের চাকরির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ক্রমশ পরিবার ভেঙে যাওয়া, বা ছোট সংসার হওয়ার জন্য অনেক মেয়ের কাছেই শিশুর দেখাশোনা করা সমস্যা হয়ে যায়।

আমি নিজে এক জন চাকরিজীবী মহিলা। আমার যমজ সন্তান হয়। পরিবারের আয়ের প্রয়োজনে আমি চাকরি ছাড়তে পারিনি। শাশুড়িমা বয়স্ক হওয়ায় দু’টি শিশুর চাপ সম্পূর্ণ তাঁর উপর দিতে পারিনি। ফলে দু’টি বাচ্চাকে শ্বশুরবাড়ি ও বাপের বাড়ি দুই জায়গায় রেখে বড় করতে হয়েছে। এর ফলে দু’জনের মধ্যে মানসিকতায় একটু তফাত গড়ে উঠেছে। যাঁদের মফস্‌সল থেকে কলকাতা যাতায়াত করতে হয়, বা দূরের রাস্তা পাড়ি দিতে হয়, তাঁদের পক্ষে একটি সন্তান মানুষ করাও চাপের। হয়তো ক্রেশ কাছাকাছি থাকলে এমনটা হত না। সেখানে শিশুকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারতাম। এখন কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পালনা স্কিম’-এ বরাদ্দও আছে। অবিলম্বে আমাদের রাজ্য সরকারকে ক্রেশ চালুর মতো অত্যাবশ্যক কাজটি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আবেদন জানাই।

টুলু সেন, উত্তর ২৪ পরগনা

পিছিয়ে বাংলা

প্রত্যেক মহিলার কাজ করার অধিকার আছে, এবং সেই সঙ্গে মা হওয়ার অধিকারও আছে। সন্তানকে নিশ্চয়ই মা লালন-পালন করবেন, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি নিজের সব কাজ, সব স্বপ্ন ছেড়ে শুধু মায়ের ভূমিকাই পালন করে যাবেন। যে অধ্যাপক কলেজে দুর্দান্ত গণিত পড়ান, তিনি শুধুমাত্র মা হয়েছেন বলে তাঁর কাজটা ছেড়ে দেবেন, এতে শুধু তাঁর ক্ষতি নয়, যে ছাত্রছাত্রীদের তিনি শিক্ষা দিতেন, তাদেরও সবিশেষ ক্ষতি।

এটি একটি উদাহরণ মাত্র। আসলে যদি কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ রাখা যায়, তা হলে মেয়েটি মন দিয়ে নিজের কাজ করতে পারবেন, কারণ তিনি জানেন তাঁর শিশুটি সুরক্ষিত আছে। তখন মনে কোনও বিবেকের দংশন হবে না। আসলে আমাদের দেশে আগে বেশির ভাগ পরিবার ছিল যৌথ পরিবার। বাড়ির প্রবীণ সদস্যদের কাছেই নাতি-নাতনিরা বেশি সময় থাকত, তাতে প্রবীণ মানুষটিও নিজেকে বেকার ভাবতেন না, তিনিও সংসারে নিজেকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন। আবার শিশুটির মা-ও নিশ্চিন্তে থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, তাই বাবা-মা কাজে বেরোলে শিশুটি কার কাছে থাকবে, তা নিয়ে সত্যিই সমস্যা দেখা দেয়। কী অভিজাত শিক্ষিত পরিবার, কী দিনমজুরের পরিবার— সব ক্ষেত্রে একই সমস্যা। ক্রেশ থাকলে আরও বেশ কিছু মহিলার কর্মসংস্থান হবে। স্বাতী ভট্টাচার্য বিভিন্ন রাজ্যের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, সেখানে ক্রেশ অত্যাবশ্যক জনপরিষেবা বলে গণ্য হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এই বিষয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। সরকারকে এই বিষয়ে আগামী দিনে আরও সচেতন হতে হবে।

এটা অনস্বীকার্য যে, মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে বেশি দায়িত্বশীল, ফাঁকি দেন না, সিগারেট বা পান খেতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করেন না। তাই মেয়েদের কাছ থেকে আরও বেশি কাজ আশা করা যাবে, যদি তাঁর পিছুটান কম হয়, অর্থাৎ তাঁর শিশুটি সব সময়ে সুরক্ষিত থাকে। এই দায়িত্ব নিয়োগকর্তাকে নিতে হবে।

সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া

অধরা প্রোমোশন

স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি জীবন সংগ্রামের কোলাজ। মাতৃত্ব যতই মহান হোক, এর মাসুল দিতে হয় প্রতিটি মেয়েকে— এ কথা নিজের জীবনে দেখেছি। আমার স্ত্রী ছিলেন সরকারি ব্যাঙ্কের কর্মচারী, সন্তান হওয়ার পর তাঁর অবস্থা হয়েছিল ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। অফিসে গিয়ে মনে হত ছেলের কথা, যদিও ছেলে থাকত আমাদের মাতৃস্থানীয়া এক মাসিমার কাছে। অনেক দিন অফিসে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে বাড়িতে, দেরি হওয়ার জন্য। ‘লিভ নট ডিউ’ এমন পরিমাণে তাঁকে নিতে হয়েছিল যে, চাকরিজীবনে তাঁর প্রোমোশন অধরাই রয়ে গেল। এ সত্ত্বেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে ছেলেকে কোলে নিতে গেলে, ছেলে মুখ ফিরিয়ে নিত অভিমানে। অথচ কেন্দ্রীয় প্রকল্প আছে, আছে বাজেট সেই ক্রেশের জন্য। কেরল, কর্নাটক, হরিয়ানা— এ সব রাজ্যে বিভিন্ন উদ্যোগে বিভিন্ন নামে এই ক্রেশের ব্যবস্থা রয়েছে, শুধু নেই আমাদের রাজ্যে। এর জন্য থাকা বাজেট বরাদ্দের খোঁজ পর্যন্ত করা হয়নি কোনও দিন। ২০১৭ সালে মাতৃত্বের সুবিধা আইনের (১৯৬১) সংশোধনের ফলে যেখানে পঞ্চাশ জনের বেশি কাজ করে, সেখানে ক্রেশ থাকা বাধ্যতামূলক। বিনা পয়সায় কিছু চাল আর হাতে এক হাজার টাকা অনুদান কতটুকু সমস্যার সমাধান করতে পারে?

দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

ভুল প্রস্তাব

‘লালন-পালনের পরিষেবা’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “অনুদান নিঃসন্দেহে গরিব মেয়েকে সাহায্য করে, কিন্তু তাঁর রোজগারের জায়গা নিতে পারে না।” এ দেশে পুরুষ বা মহিলা, কারও জন্য কাজ ও যথাযথ মজুরির ব্যবস্থা করা গিয়েছে কি? শুধু দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বেই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কম মজুরি দেওয়া হয়। কোন যুক্তিতে, জানা যায় না। প্রবন্ধকারের প্রশ্ন, “কেন ক্রেশের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রের টাকা আজ পর্যন্ত দাবি করেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার?” ক্রেশ তৈরির সমাধান কতটা বাস্তবসম্মত, যেখানে একশো দিনের কাজের মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র? রাজ্যের যে সমস্ত মানুষ একশো দিনের কাজে প্রকৃতই যুক্ত থেকেছেন, তাঁদের টাকা দীর্ঘ দিন আটকে রাখার পিছনে যুক্তিটা কী? এটা প্রমাণিত সত্য যে, অ-বিজেপি সরকার আছে যে সব রাজ্যে, তাদের প্রতি নানা ভাবে বৈষম্য চালিয়ে যাচ্ছেন শাসক। এর পর আবার ক্রেশ-এর জন্য নিয়মিত টাকা আদায় করা রাজ্যের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব! এই প্রস্তাব প্রহসন ছাড়া কী হতে পারে?

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

পিঠে শিশু

বিভিন্ন রাজ্যের আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিকে ক্রেশরূপে ব্যবহার, একশো দিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত করার প্রকল্পটি আমাদের রাজ্যে ফলপ্রসূ হওয়ার আশা কম। কারণ, এই খাতে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ বরাদ্দ করে। তাই বিষয়টি জটিলতার সৃষ্টি করেছে। অথচ, ক্রেশের প্রয়োজন আছে। গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা (বিশেষত জনজাতি সম্প্রদায়ের) শিশুকে পিঠে কাপড়ে বেঁধে নিয়ে কাজ করছেন, এই ছবি এখনও বদলায়নি। পঞ্চায়েতের ভূমিকা কী হবে, সে প্রশ্নও থাকে। কারণ, স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্পটিতে শুরুর দিকে পঞ্চায়েত স্থানীয়দের সহযোগিতায় আনাজপাতির ব্যবস্থা করত। কিন্তু এখন তেমনটি হয় না। ফলে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নাভিশ্বাস উঠছে।

প্রবন্ধকারের সঙ্গে আমি সহমত যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ঘরে ও বাইরের গুরুদায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়। আঠারো শতক থেকে আজ পর্যন্ত এই জীবনযন্ত্রণার কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি।

সুবীর ভদ্র, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Working Mother West Bengal government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE