২৫ মে চলে গেল কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী। এরই পাশাপাশি চুপিসারে পার হয়ে যাচ্ছে আরও একটি স্মরণীয় ঘটনা— এ বছর তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ। ১৯২১ সালে ডিসেম্বরের এক শীতের দিনে অমন আগুন ঝরেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে সবে দু’বছর হল। নজরুল তখন কলকাতায় তালতলা লেনের ৩/৪ সি বাড়িটিতে একতলায় ভাড়া আছেন। একই ঘরে রয়েছেন মুজফ্ফর আহমেদ, পরে যিনি হয়ে উঠবেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিশারি। তত দিনে নজরুল লিখেছেন: ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘রাক্ষসী’; উপন্যাস: ‘বাঁধনহারা’; কবিতা: ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি। এ দিকে মুজফ্ফর এই ঘরে বসেই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছেন। খিদিরপুরের জাহাজের খালাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, বিভিন্ন শ্রমিক সভায় অংশ নিচ্ছেন। ইচ্ছা, শ্রমিকদের সংগঠিত করা। সক্রিয় যোগদান না থাকলেও একই ঘরে থেকে নজরুল সব দেখছেন, সব শুনছেন। এ দিকে এই সময়ে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের উদ্দীপনা ভারতেও তরুণদের ছুঁয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এক রাতে কবিতাটি লিখেছিলেন, এবং সকালে মুজফ্ফর আহমেদকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। নজরুল সাধারণত দোয়াত-কলমে লিখতেন। বার বার দোয়াতে কলম চুবিয়ে লিখলে প্রবাহ হারিয়ে যাবে, কবিতার সুর-তাল কেটে যাবে, এই আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত নজরুল পেনসিল দিয়ে কবিতাটি লেখেন।
মনে হয়, নজরুল এই কবিতা দিয়েই নিজের রাজনৈতিক পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। এর পরের ঘটনাবলি তা-ই ব্যক্ত করে। কবিতাটি বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯২২-এর ৬ জানুয়ারি এবং ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। এর পরেই ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নজরুল এবং ধূমকেতু শুধুমাত্র আর পত্রিকা থাকে না, ঝড়ে রূপান্তরিত হয়। বিপ্লবীদের কাঁপিয়ে দিচ্ছে একের পর এক লেখা। নজরুল নিজে লিখলেন, ‘আনন্দময়ীর গান’; রাজদ্রোহে বন্দি হলেন। এমত নানাবিধ... পুনরুল্লেখ বাতুলতা মাত্র। তবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুধু ইংরেজশাসন-বিরোধী বললে একে ছোট করা হয়, এ অত্যাচার-বিরোধী, শোষণ, নিপীড়ন-বিরোধী। কেবল সাহিত্য নয়, রাজনীতিরও ক্রান্তিকাল নির্দেশ করে কবিতাটি।
সৌরভ চক্রবর্তী, সান্তাক্রুজ, মুম্বই
ব্রাত্য নাচনি
‘নাচনিদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে এখন শুধুই হতাশা’ (রবিবাসরীয়, ২৩-৫) নিবন্ধের শুরুতেই প্রবীর সরকার বলেছেন, “যে নাচে সে-ই নাচনি।” কিন্তু ধ্রুপদী নৃত্যের শিল্পী, কিংবা বিখ্যাত সৃজনশীল নৃত্যশিল্পীদের ‘নাচনি’ বলা হয় না। মানভূম-ধলভূমের প্রাচীন আঞ্চলিক সংস্কৃতির নৃত্যের সঙ্গে যুক্ত, নিম্নজাতির পেশাগত নৃত্যশিল্পীদের ‘নাচনি’ আখ্যা দেওয়া হয়। সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচাৰ্যের ‘নাচনী’ উপন্যাসে নাচনির কথা আমরা পড়েছি, এবং উপলব্ধি করেছি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ধারাবাহিক ‘রসিক’ গল্পটিও পড়েছি। সেখানে গ্রামের এক শ্রেণির নিম্নজাতির বাহুবলী জমিদার দু’-তিন জন নিম্নবর্গের দরিদ্র মেয়েকে জোর করে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলেন, এবং জীবনধারণের জন্য রসিক অর্থাৎ নাগরের ঝুমুর গানের সঙ্গে সেই মেয়েদের নাচের তালিম দিয়ে ‘নাচনি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার ফলে সমাজের চোখে এদের প্রথম পরিচয় ছিল ‘রসিকের রক্ষিতা’। তাদের প্রতি সমাজের ঘৃণা ও অবজ্ঞার মনোভাব থেকে যায় আমৃত্যু। আবার সেই মানুষরাই রাত জেগে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তাদের নাচ উপভোগ করে, তাদের শাড়িতে কিংবা চুলে নোট গুঁজে দেয়।
নাচনিদের পীঠস্থান পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে কিছু জাতির মধ্যে ‘নাচনি’ শব্দটি গালিগালাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের অভিনয়ে, এবং রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের নাচনি নাটকে এই মেয়েদের শেষ জীবনের দুর্দশার ছবিটি প্রতিফলিত হয়েছে। মাসিক হাজার টাকা শিল্পীভাতা হিসেবে পেনশন পেয়েছেন কয়েক জন। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের উদাসীনতায় আজ পুরুলিয়ার এই লোকসংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে।
তপন কুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
রসিকও সঙ্কটে
প্রবীর সরকারের নিবন্ধে নাচনি ও রসিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নাচনিদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রসিক। এক জন রসিকের তত্ত্বাবধানে এক জন নাচনি নৃত্য ও সঙ্গীতকলাতে নিপুণ হয়ে ওঠে। নাচনির নৃত্যের তালে তালে রসিকের বাদ্যের ঝঙ্কার আসরকে জমিয়ে তোলে। মঞ্চের জৌলুস, নাচনিদের ঝলমলে পোশাক, নৃত্যকলার পারদর্শিতা দর্শকমহলকে মুগ্ধ করে ঠিকই, কিন্তু তাদের অন্ধকারময় জীবনের পরিচয় কেউ পায় না, বা কেউ খোঁজ রাখে না।
এই যন্ত্রণা শুধু নাচনিরাই ভোগ করে তা কিন্তু নয়, নিবন্ধটিকে সামনে রেখে বলতে পারি— “নাচনির সঙ্কট আর রসিকের সঙ্কট এক সুতোয় বাঁধা।” রসিকদের নাচনিদের উপর শোষণ ও একাধিপত্যের কথা অনেক ক্ষেত্রে শোনা যায়, কিন্তু শাসক-শোষিতের সম্পর্ক তাদের কখনও নয়। বরং উভয়ই আমাদের সমাজে যখন ব্রাত্য ও অবহেলিত হয়েছে, তখন তারা একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে একত্রে জীবন অতিবাহিত করেছে।
জয়া ধীবর, পলাশতলা, বাঁকুড়া
পরিণতি
নাচনিদের শেষ পরিণতি অত্যন্ত করুণ। যার দেহলাবণ্যে, নাচে মশগুল থাকত দর্শক, সেই নাচনি যখন মারা যেত, কেউ সৎকারের জন্য এগিয়ে আসত না। অন্য নাচনিরা মৃত নাচনির পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়ে দাহকার্য করত। রসিকদের হাতে নিজের রোজগারের পুরো টাকা তুলে দিতে হত নাচনিদের, মারধরও খেতে হত। রসিকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিবাহিত হত, নাচনির বয়স বাড়লে পত্রপাঠ তাকে ত্যাগ করে নিজের সংসারে ফিরে যেত। ভিক্ষাবৃত্তি করেই তখন নাচনিকে বাঁচতে হত।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
শিল্পী ঈশা
‘শিল্পিত জীবন’ (কলকাতার কড়চা, ২২-৫) শিল্পী ঈশা মহম্মদকে তুলে ধরেছে শ্রদ্ধায়। যাঁদের কাজের প্রতি আমাদের চোখ, জীবনের দিকে সাগ্রহ দৃষ্টি, সেই সব মানুষ চলে গেলে অসহায় লাগে বইকি! শিল্পসংক্রান্ত একাধিক অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওঁর আপাতকঠিন মুখমণ্ডলের পিছনে বরাবরই ছিল এক বন্ধুত্বসুলভ সৌজন্য। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ছিলেন সুদক্ষ সংগঠক। তবে সব ছাপিয়ে তাঁর ছবির জগতের কথাই বেশি মনে পড়ে। ঈশা মহম্মদের ছবির ভুবন প্রধানত তাঁর চার পাশের মানুষজনকে ঘিরে রচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের ছবি। বাড়ির অন্দরে রোজকার আটপৌরে জীবন, ঘরোয়া অনুষ্ঠান যেমন আছে, তেমনই উঠে এসেছে মফস্সলের আলো-ছায়া ঘেরা দোকান-বাজারে ব্যস্ত ভিড়। কখনও খানিকটা দূরের, প্রান্তিক মানুষের জীবন— সমুদ্রতটের মাঝিমাল্লা, জেলে দম্পতি। তাঁর প্যালেটে বরাবরই একটু চাপা রঙের প্রাধান্য, মৃদু উদ্ভাসিত দ্যুতি ঘিরে থাকে ছবিকে। তবে ছবির জোরালো ড্রয়িংটাই তাঁর চিত্রকলার বিশেষ উপাদান। এক দিক থেকে ভাবলে ঈশা মহম্মদের চিত্রমালা যেন এক পোর্ট্রেট সিরিজ়। তবে শেষের দিকে শিল্পী যেন এই আবহ থেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে, ছবির অভিমুখ সরে যাচ্ছিল বিমূর্ত অবয়বের দিকে। মোটা তুলির আঁচড়ে, উজ্জ্বল রঙের ঘনঘটায় ভরে উঠছিল শিল্পীর ক্যানভাস।
সুশোভন অধিকারী, শান্তিনিকেতন, বীরভূম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy