করোনার আক্রমণ মোকাবিলার চিন্তায় যখন সাধারণ মানুষ ব্যাকুল, গৃহবন্দি, দিশাহারা, তথ্যের অত্যাচারে বিভ্রান্ত এবং আক্ষরিক অর্থেই নতজানু হয়ে পথ খুঁজছেন, তখনও আস্তিন গুটিয়ে রাজনীতির চিরাচরিত খেলা এবং মুষ্টিযুদ্ধ! অনেকেরই প্রশ্ন, এই প্রলয়ের কালে এটা কি একটু ভুলে থাকা যায় না? সরকারকে একমাত্র আশ্রয় ভেবে সরকার নির্ধারিত অনুশাসনের বেড়াজালে আটকে রয়েছেন মানুষ। কিছু ঢিলেমি থাকলেও সামগ্রিক ভাবে সরকার যা বলছে তা মেনে চলার এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের চেষ্টাই চোখে পড়ছে। পারস্পরিক সংহতি এবং সমন্বয়ের কথাই যখন শোনা দরকার, আর মানুষ তা শুনতেও চাইছেন, তখনও রাজনৈতিক বিভাজনে মানুষকে পীড়িত করলে লড়াইটাই বিপথে চলে যাবে না কি?
কে আগে অশান্তি সৃষ্টি করছেন আর কে পরে, সেই বিতর্কের সময় এটা নয়। এখন একটা বিষয়ই সুস্পষ্ট ভাবে ঠিক করা দরকার। করোনার লড়াইটা কোন মাঠে হবে? যে পথ অভিপ্রেত তা হচ্ছে, বিজ্ঞানের খবর হাতে নিয়ে এবং বিজ্ঞানেরই দেখানো পথে মানুষকে আগলানোর জন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে পথ হাঁটবেন রাজনীতিবিদেরা। আর এটা করবেন, মানুষের স্বার্থে তো বটেই, সর্বোপরি নিজের স্বার্থে— মৌচাক না থাকলে মউলে বাঁচে না। অন্য পথটা হল কানাগলি, যেখানে রাজনীতিকরা ঢুকে পড়তে পারেন ‘আমি কী পাব’ ভাবতে ভাবতে, ‘ও ওটা করলে আমি এটা কেন করব না’ বলতে বলতে। এটা অবশ্যই সর্বনাশের পথ।
যাঁরা মঞ্চে আছেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই আবেদন, হাতে হাত ধরে এই সময়টায় মানুষকে শুধু ভরসাই দিই না সবাই আমরা! যাঁরা ঘরে বসে কাঁপছেন আর খবর শুনছেন— ওই করোনা এল আমার দরজায়, তাঁদের যদি একটু সত্যনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা যায়, তাতে শঙ্কা কমবে, মানুষও ভাল থাকবেন। মনে রাখা দরকার, আতঙ্কিত সংশয়গ্রস্ত জনসমষ্টিকে নিয়ে এ রকম জনস্বাস্থ্য সঙ্কটের সুচারু মোকাবিলা হতে পারে না। এই মুহূর্তে সব পক্ষেরই কাজ মানুষকে সাহস জোগানো। আত্মসন্তুষ্টির কোনও অবকাশ নেই, আবার পাশা খেলারও সুযোগ নেই। সবাই আমরা ট্রাপিজ়ের এক এক কোণে দড়ির উপর দিয়ে পথ হাঁটছি।
এখানে বলা দরকার, বিজ্ঞান ভাতের থালা নয় যে তার কিছুটা নেব আর বাকিটা ফেলে দেব। বিজ্ঞানের তথ্য কাটছাঁট করে নিতে গেলে হদিশ মেলে না, বরং তা ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞান বহু সময় এমন কিছু তথ্য এনে দেয় যা রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর, এমনকি উদ্বেগজনক। এর কারণ, তথ্য তুলে আনার সময় বিজ্ঞান বাইরের প্রভাব— যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে ‘এক্সটার্নালিটি’— তার থেকে সাধারণ ভাবে মুক্ত থাকে। অন্য দিকে, রাজনীতিককে সব সময় ভাবতে হয় পিচে দাঁড়িয়ে তিনি যে শটটা নিলেন তাতে গ্যালারির দর্শক কতটা আলোড়িত হবেন। দু’দলের লক্ষ্যের মেলবন্ধন না ঘটলে কারও লাভ হয় না। বিজ্ঞানের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এবং সমাজে প্রয়োগযোগ্য করার জন্য সব দিক বুঝে নিতে হয় রাজনীতিককেই। আর এই কাজটা ভাল ভাবে করার আবশ্যিক শর্তই হচ্ছে অহেতুক সন্দেহের বশবর্তী না হয়ে বিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখা। রাজনীতিককে বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব বুঝতে হবে, তার বাধ্যবাধ্যকতা নেই। কিন্তু যেহেতু তাঁরা মানুষের ভাষা বোঝেন এবং মানুষের মঙ্গলের হকদার, তাই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, সততা আর বস্তুনিষ্ঠা না থাকলে মানুষেরও ক্ষতি, ক্ষতি তাঁদেরও। তাই, বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিক, দুই তরফের কথা বলার পরিসরটা যত বিস্তৃত হয়, তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়া যত জোরদার হয়, তত ভাল।
অন্য দিকে, বিজ্ঞানীকেও বাস্তবতার কথা খেয়াল রাখতে হয়। বুঝতে হয় রাজনীতিকের মতিগতি, দর্শন এবং কাজের ধারা। কঠিন মুহূর্তে উদ্বেগকাতর রাজনীতিক হয়তো বিজ্ঞানের কথা বুঝতে পারেন না। কিন্তু বার বার কথা বলার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে মানুষের স্বার্থে বিজ্ঞান-নির্ভর করে তোলার কাজটাও বিজ্ঞানীকেই করতে হয়। এর কোনও বেঁধে-দেওয়া স্বরলিপি নেই। ভাষাশৈলী ইত্যাদি চর্চার মধ্যে দিয়েই সেই বোঝানোর পারঙ্গমতা আয়ত্ত করতে হয়। কাজটা সহজ নয়। সামগ্রিক ভাবেই, আমাদের দেশে রাজনীতিকদের মধ্যে প্রমাণ এবং তথ্যের উপর নির্ভর করে নীতিনির্ধারণের সংস্কৃতি এখনও ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠেনি। চটজলদি সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক বাধ্যতার উপর নির্ভর করে পথ বেছে নিতেই তাঁরা অভ্যস্ত। এটা মাথায় রেখেই এখন তাঁদের বোঝানোর কাজটা অনুশীলন করা দরকার। এটাও বোঝা দরকার যে, ব্যতিক্রমী রাজনীতিক জিতে বেরিয়ে আসেন বিজ্ঞানের ফুল হাতেই।
করোনার আবহে আমাদের প্রত্যেকের জীবনটাই নানা ভাবে বদলে গেছে। বন্দিদশা আর বিচ্ছিন্নতা জন্ম দিচ্ছে সুরক্ষাহীনতার অনুভূতির। তার সঙ্গে অনেকেই, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, মেতে উঠেছেন পুরনো অঙ্ক মিলিয়ে নিয়ে বদলা নেওয়ার অবশ্য-বর্জনীয় অপসংস্কৃতিতে। সবার মনে রাখা দরকার, কোনও রাজনীতিকই করোনাকে ডেকে আনেননি। দৃঢ় প্রত্যয়ে, স্বচ্ছতা ও হৃদয় নিয়ে মানুষের পাশে থাকছেন যাঁরা, লোকে তাঁদেরই মনে রাখবে। মানুষ বিজ্ঞানের চুলচেরা খবর না জানতে পারেন, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান বস্তুটা তাঁদের আছে! তাঁদের বোকা ভাবার কারণ নেই। রাজনীতিকরা যদি এই কথাটা মাথায় রাখেন, তা হলে সবার মঙ্গল।
চিকিৎসক, লিভার ফাউন্ডেশন-এর সচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy