সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছড়িয়েছে অসুখ। ফাইল ছবি।
২০২০ সালের ২০ মে-র সন্ধ্যা। বিকেল থেকে সোঁ সোঁ হাওয়া। বিকেলেই রাতের অন্ধকার। একটা সময় বাতাসের তীব্রতা এতটাই বেড়ে গেল যে লন্ডভন্ড হয়ে গেল সব। বঙ্গোপসাগরে এর আগে কম ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়নি! ২০০৭ সালের পর থেকে পর পর এসেছে সিডার, আয়লা, ফণী। কিন্তু কলকাতার এমন হাল কখনও হয়নি।
মোটা মোটা গাছ উপড়ে গিয়েছে। বহুতলের কাচ ঝন ঝন করে ভেঙে পড়েছে। রাস্তায় উড়ে এসেছে টিন। ছাদ থেকে জলের ট্যাঙ্ক আছড়ে পড়েছে নীচে। ল্যাম্পপোস্ট উল্টে পড়েছে। গাছের সঙ্গে জড়ামড়ি করে রাস্তায় ছিঁড়ে পড়েছে বিদ্যুতের তার। কলকাতার বড় অংশ বিদ্যুৎবিহীন। কোথাও কোথাও কিছুক্ষণ পরে আলো ফিরে এলেও বিস্তীর্ণ এলাকা অন্ধকারেই ছিল। কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ ফিরতে সময় লাগল সাত-আট দিন। আলো নেই, জল নেই। পদে পদে মরণফাঁদ। কলকাতা যেন মৃত্যুপুরী। উপড়ে-পড়া গাছ সাফ করতে সময় লাগল দু’মাস।
কলকাতার হাল কেন এমন হল? সুন্দরবনে এর আগেও আছড়ে পড়েছে একাধিক ঘূর্ণিঝড়। তার জেরে কলকাতার এমন অবস্থা আগে হয়নি। আসলে গত ৩০০ বছরে এমন প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেনি কলকাতাকে। ঘন্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে ঘুর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার সময় কেমন ছিল মহানগরের অবস্থা? বাইপাস সংলগ্ন একটি বহুতলের ১৮ তলার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘সোঁ সোঁ করে হাওয়া ধাক্কা মারছে কাচে। গোটা ফ্ল্যাটটা থর থর করে কেঁপে উঠছে। টিভি-তে টর্নেডার ভয়ঙ্কর চেহারা দেখেছি। মনে হল বাতাস ঘুরতে ঘুরতে যেন আমাদের আবাসনকে গ্রাস করতে আসছে। এক সময় লাইট চলে গেল। ফোনেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির কুকুরটা চিৎকার করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল বোধহয় সব শেষ হয়ে যাবে।’’
২০ মে রাতে মৃত্যুভয় গ্রাস করেছিল অনেক কলকাতাবাসীকে। ২০০৯ সালে আয়লাও আঘাত করেছিল সুন্দরবনে। বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলি। কিন্তু কলকাতায় ঘন্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি তীব্রতার ঝড় আঘাত করেনি। প্রচুর গাছ পড়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু ঘটেনি। সুন্দরবনে সেই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার। তবে কলকাতায় পৌঁছতে পৌঁছতে তার গতিবেগকমে গিয়েছিল। কিন্তু এবার সুন্দরবনে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে আছড়ে-পড়া ঝড় তার তীব্রতা না কমিয়েই আঘাত করেছিল মহানগরীতে।
২০০৪ সালের শেষ ডিসেম্বরে সুনামির তাণ্ডব থেকে বেঁচে গিয়েছিল সমুদ্র লাগোয়া বেশ কিছু এলাকা। তামিলনাড়ু, আন্দামান আর শ্রীলঙ্কা উপকূলের যে অংশে ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল ছিল, সেগুলি ধ্বংস করতে পারেনি ওই প্রাকৃতিক তাণ্ডব। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বিপুল জলরাশিকে আটকে দিয়েছিল। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য কলকাতা শহরে ঢোকার পথে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে বরাবর। শুধু ঝড়ের গতি আটকানোই নয়, ফুলেফেঁপে ওঠা সমুদ্রের জল থেকে ভূমিক্ষয় রোধের একমাত্র প্রতিবিধান এই ম্যানগ্রোভ। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ঘনত্ব কমে যাওয়াতেই আমপানের ঝড় তেমন ভাবে প্রতিহত করতে পারেনি এই প্রাকৃতিক দেওয়াল।
ম্যানগ্রোভ গাছ নয়। গাছের একটি প্রজাতি। এরা লবণাম্বু উদ্ভিদ। অর্থাৎ, যে জমিতে নুনের ভাগ বেশি, এরা সেখানে জীবনধারণ করতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য এই জাতীয় গাছের প্রজাতির বেশ কিছু অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য আছে। সমুদ্রের তীরবর্তী যে সব জমি দিনের অর্ধেক সময় জোয়ারের জলে ডুবে থাকে এবং বাকি সময়ে জল নেমে যায়, সেখানেই জন্মায় ম্যানগ্রোভ। সুন্দরবনেও তেমনই হয়। কথিত যে, সুন্দরবনের নাম একটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ থেকে এসেছে। সুন্দরী ছাড়াও গর্জন, গেঁওয়া, বাইনের মতো লবণাম্বু উদ্ভিদ নিয়েই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই প্রজাতি মাটি থেকে অতিরিক্ত নুন শোষণ করে তা পাতায় সঞ্চয় করে রাখে। নুনের পরিমাণ সম্পৃক্ত হয়ে গেলে সেই পাতা গাছ থেকে খসে পড়ে। এই ভাবে ম্যানগ্রোভ মাটিতে নুনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল যত ঘন থাকবে, তার প্রচণ্ড বেগের ঝড় বা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বাড়বে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছড়িয়েছে অসুখ। একটি অসুখ পুরোপুরি প্রাকৃতিক। অন্যটি মানুষের তৈরি। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতে উঁচু হচ্ছে ঢেউ। জলোচ্ছাসে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই ঢেউ এসে পড়েছে সুন্দরবনেও। গত ১০-১৫ বছরে ঘোড়ামাড়া দ্বীপ পুরোপুরি চলে গিয়েছে সমুদ্রবক্ষে। জম্বুদ্বীপের বড় এলাকা বিলীন। ওই দুই দ্বীপের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল পুরোপুরি বিনষ্ট। তাই ওই এলাকা দিয়ে জোরালো বাতাস চলে আসছে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার লোকালয় ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে। আমপান তার প্রমাণ। আর এ সব জানা সত্ত্বেও ম্যানগ্রোভের জঙ্গল কেটে লোকালয় তৈরির কাজ চলছে নদী সংলগ্ন কিছু অংশে। সুন্দরবনের গভীরতম এলাকার সুন্দরীর গাছের আকৃতি দেখলেই পরিষ্কার যে, গাছের ঘনত্ব কী বিপজ্জনক ভাবে কমছে। উপগ্রহে চিত্রে সুন্দরবনের মাঝখানটা দেখলে মনে হবে টাক পড়ে গিয়েছে। আসলে মাটিতে অত্যাধিক নুনের উপস্থিতি সুন্দরী গাছের অভিযোজনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। গাছগুলি বেঁটে হয়ে গিয়েছে। ঝাঁকড়া হচ্ছে না। ঠেসমূলের বুনোটও জমাট হচ্ছে না। ঝড়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
ম্যানগ্রোভের এই অভিযোজন এবং ব্যাপক হারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হওয়ায় সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র বদলে যেতে বসেছে। খাদ্য-খাদক সকলেরই বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সঙ্কটে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও। মে মাসের আমপান দেখিয়ে দিয়েছে, শুধু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নয়, ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের দাম চুকোতে হচ্ছে কলকাতাকেও। এখনও সতর্ক না হলে, সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে না পারলে, ম্যানগ্রোভ ধ্বংস আটকাতে না পারলে একদিন আমপানের থেকেও শক্তিশালী কোনও ঝড় ধ্বংস করে দিতে পারে সাধের কলকাতাকে। ধ্বংস হওয়া ইউরোপীয় শহর পম্পেইয়ের পাশে লেখা হতে পারে কলকাতার নাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy