Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

খোলা আকাশে খেলে বেড়ায় রঙিন ভোকাট্টা ঘুড়ি

ঘুড়ি নিয়ে আকাশে কাটাকুটি খেলায় শান্তিপুরের মানুষ রথযাত্রার দিনকে বেছে নিয়েছে। যে খেলা বর্তমানে একটি আঞ্চলিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। উল্টোরথে ঘুড়ি উৎসব নিয়ে লিখছেন রাহুল হালদারঘুড়ি নিয়ে আকাশে কাটাকুটি খেলায় শান্তিপুরের মানুষ রথযাত্রার দিনকে বেছে নিয়েছে। যে খেলা বর্তমানে একটি আঞ্চলিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। উল্টোরথে ঘুড়ি উৎসব নিয়ে লিখছেন রাহুল হালদার

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯ ০২:৫৪
Share: Save:

আষাঢ় মাসের রথযাত্রা উপলক্ষে সারা শান্তিপুর জুড়ে দেখা যায় ঘুড়ির ওড়ানো। যাকে কেন্দ্র করে আকাশে নানা রঙের ঘুড়ির কাটাকুটি খেলা। এক-একটি পাড়ায় অথবা কোনও পাড়ার ছেলেরা একাধিক দলে ভাগ হয়ে মাঠে, ছাদে তাঁবু খাটিয়ে, মাইক নিয়ে সকাল সকাল মেতে ওঠে ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায়।

আষাঢ় মাসের অন্ধকার দূর হওয়ার পর দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার দিন এবং তার সাত দিন বাদে তিন ভাই-বোন মাসির বাড়ি থেকে ফিরে আসার দিন যে উল্টোরথ হয়, এই দু’টি দিনে শান্তিপুরের আকাশ দখল করে নেয় নানা রংবেরঙের, বিভিন্ন নামের অসংখ্য ঘুড়ি। পাখিদের মতো সারা আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় সেই সব ঘুড়ি। আর এই দিনে সকল বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো করে আনন্দ উপভোগ করে রথযাত্রার মেলা আর ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে।

ভারত তথা সমগ্র বাংলার মানুষের সাধারণত মকরসংক্রান্তি দিন কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে ঘুড়ি ওড়ায়। সেখানে ব্যতিক্রম দেখা যায় নদিয়া জেলার শান্তিপুরে। কবে থেকে কিসের জন্য শান্তিপুরের মানুষজন রথের দিনটাকে ঘুড়ি ওড়ানোর দিনে পরিণত করেছে, তার উৎস সন্ধানে না গিয়ে আমরা দেখি এখানকার জনগণ রথকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে কী ভাবে। প্রাচীন দুই গোস্বামী যথা বড় গোস্বামী বাড়ির ও মধ্যম গোস্বামী বাড়ির জগন্নাথ দর্শন করে আর মেলায় জিলিপি পাঁপড়ভাজা খায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় সারা দিন ঘুড়ি ওড়ানো।

আজ থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগে পৃথিবীর মধ্যে চিন দেশে সর্ব প্রথম ঘুড়ি ওড়ানোর সূত্রপাত হয়। সে সময়ে কাগজের আবিষ্কার না হলেও তারা হালকা কাপড় দিয়ে ঘুড়ি তৈরি করতেন। তার পর এশিয়া অতিক্রম করে ঘুড়ি ওড়ানো খেলা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়। পরবর্তী কালে ঘুড়ি ওড়ানোর এই অবকাশকালীন বিনোদন ধীরে ধীরে এশিয়ার অন্য স্থানে যথা ভারত, জাপান কোরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। আর এখনকার দিনে ঘুড়ি ওড়ানো মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয় যে, বিনোদনটি একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলার মানুষ বিশ্বকর্মা পুজো আর মকরসংক্রান্তির দিন ঘুড়ি ওড়ানোয় মাতে।

শান্তিপুরের মানুষ রথযাত্রার দিনকে বেছে নিয়েছে ঘুড়ি নিয়ে আকাশে কাটাকুটি খেলতে। যে খেলাটি একটি আঞ্চলিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। অবশ্য রথের দিনকে বেছে নিলেও এই খেলার প্রস্তুতি কিন্তু অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিক থেকেই বিকালের আকাশে একটা-দুটো করে ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। যাকে বলা যেতে পারে ফাইনালে নামার আগের প্রাক্‌প্রস্তুতি। বিগত বছরে লাটাইয়ে থেকে যাওয়া সুতো দিয়ে হাত-পায়ের আড়ষ্ঠতা কাটানো বা মনের আনন্দে মাঝআকাশে ঘুড়ি নিয়ে জারিজুরি করা।

এর পর ধীরে ধীরে দিন যত এগিয়ে আসে, ঘুড়ি ওড়ানোর সরঞ্জাম তৈরির ব্যস্ততা চোখে পড়ে। যদিও বর্তমান কালে এই সকল সাজ-সরঞ্জাম যথা মাঞ্জা দেওয়া সুতো, লাটাই সম্পূর্ণ তৈরি করা অবস্থায় পাওয়া যায়য় যদিও কিছু বছর আগে সেটা ততটা সুলভ ছিল না। দোকানিরা এই সময়ে মাঞ্জা ছাড়া সুতো, কাগজের ঘুড়ি নিয়ে দোকান সাজিয়ে রাখতেন। দোকানের সামনে দড়িতে ঝোলানো থাকত নানা রকমের সুতোর বান্ডিল। লালগান, কালোগান, জেপিসি, শিকল প্রভৃতি। সুতোর এই নামকরণ আমরা করেছিলাম সেই সমস্ত সুতোর বান্ডিলের গায়ে কাগজের কভারের উপরে আঁকা আর লেখা দেখে। এক একটি সুতোর বান্ডিল ছিল এক হাজারি। সুতোর সরু মোটার উপর নির্ভর করত সুতোর দাম। যার যেমন কেনার সামর্থ্য থাকত সাধ্যমতো সেই সুতো কিনত। সুতো কেনার পর শুরু হত সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার প্রস্তুতি আর তার জন্য প্রয়োজন হতো কাচের গুড়ো, খই, সাগুর আঠার।

সুতো মাঞ্জায় প্রথমে হামানদিস্তাতে কাচের মিহিগুড়ো তৈরি করে নেওয়া হত। তার পর একটা পাতলা কাপড়ের টুকরো দু’জনে লম্বালম্বি ধরে সেটার মধ্যে জলে ভেজানো খই হাত দিয়ে ঘষে ঘষে তালের বড়া তৈরির সময় তাল থেকে ঘষে যেমন রস নিংড়ে নেওয়া হয় তেমনই খই থেকে খইয়ের নির্যাস বার করা হয়। এর পর সেই নির্যাসের সঙ্গে গুড়ো করা কাচ, সাগুদানার আঠা মিশিয়ে একটি মণ্ড তৈরি করা হত। এ বার কিনে আনা সুতো যেটা জলে ভিজানো থাকত সেটায় মাঞ্জা দেওয়ার জন্য অনেকটা দূরে দুটো বাঁশ পোঁতা হত আর সেই বাঁশে খবরের কাগজ ভাল করে জড়ানো হত। সবকিছু প্রস্তুত করার পর নেওয়া হত দুই-তিন ইঞ্চি করে কাটা সুতির মোটা কাপড়, যেটাকে টিপ ধরার কাজে লাগানো হত। তার পর এক জন লাটাই ধরে সামনে এগোত। আরেক জন হাতের মুঠোতে মণ্ড সুতোতে লাগাতে লাগাতে যেত আর শেষে এক জন দু’হাতে দুটো সুতির কাপড়ের টুকরো সুতোয় থাকা মোটা মণ্ডের প্রলেপ চেঁছে পরিষ্কার করত। এর পর সুতো রোদে শুকিয়ে গেলে লাটাইয়ে তুলে নেওয়া হত। শান্তিপুর যেহেতু হাতে সুতো কাটা চরকার প্রচলন আছে, তাই অনেকে সুতোকে চড়কিতে জড়িয়ে নিয়েও মাঞ্জা দিত। এই কাজ দলগত প্রচেষ্টার ছাড়া সম্ভব হত না। ফলে পাড়ায় পাড়ায় সমবয়সী কিংবা অসম বয়সীদের মধ্যে একটা একাত্মবোধও গড়ে তুলতে সাহায্য করতো ঘুড়ি উৎসব।

সুতো প্রস্তুত করার পর চলত ঘুড়ি কেনার আয়োজন। অবশ্য কেউ কেউ নিজেরাই ঘুড়ি তৈরি করত। হালকা কাগজ, মুলিবাঁশের সরু কাঠি দিয়েই তৈরি করত নানা রকমের, নানা সাইজের ঘুড়ি। ঘুড়ি মাপ শুরু হত সিকিতে দিয়ে, তার পর একতে, দেড়তে, দুতে আর কোনও কোনও দোকানি দোকানে সাজিয়ে রাখত দু-একটা পাঁচতে ঘুড়ি। বিচিত্র রকমের ঘুড়ির মাপ সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ির নামগুলিও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। পেটকাটা, মাথাকাঠি, বুককাঠি, পাশকাঠি, জেব্রা, ডুগডুগি, বলকাঠি, মুখপোড়া, সাদাচিন, কালোচিন, লালচিন, গলায় মালা, শতরঞ্চ, ময়ূরপঙ্খী ইত্যাদি।

এই ভাবে সারা দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনির পর সমস্ত কিছুর আয়োজন হয়ে গেলে রাতে হত বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পিকনিক। তার পরে রথের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে খুব সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই রোদ ওঠার আগে একে একে রঙিন ঘুড়ি আকাশে ছেয়ে দেওয়া হয়। বড় আকাশটা তখন অসংখ্য ঘুড়ির দাপাদাপিতে যেন ছোট হয়ে যায়। শুরু হয় প্যাঁচ খেলা।

সুতো টেনে কিংবা ছেড়ে প্যাঁচ খেলতে খেলতে যখন কোনও একটা ঘুড়ি কেটে গিয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অজানার উদ্দেশ্যে ভেসে বেড়ায় তখন সেই ঘুড়ির পিছু নেয় একদল লাঠি বা কঞ্চি সমেত অল্প বয়েসের ছেলের দল। এদের কাজই হল কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরা আর সেগুলি অল্প পয়সায় আবার বেচে দেওয়া। ভোকাট্টা হওয়া ঘুড়ি মাটিতে পড়ার আগে কয়েক দফা ভেল্কি নাচনের খাইয়ে সে তাদের কাছে ধরা দেয়।

তার পর সেই ঘুড়ি চলে যায় বাড়ির বাচ্চাদের জিম্মায়। যে বাচ্চাদের কাজ হয় ওই দিন বড়দের ঘুড়ি আকাশে খেলার প্রাক্কালে লাটাই ধরে রেখে সাহায্য করা।

এই ভাবে সারা দিন রোদে পুড়ে, জলে ভিজে হাসিমুখে শান্তিপুরের মানুষেরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে মেতে ওঠেন। আজও সেই উৎসবের উন্মাদনা কিছুটা কমলেও তার উৎসাহে ভাটা পড়েনি।

বিগত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ বান্ধব কাগজের ঘুড়ির বদলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঘুড়ি আর রেডিমেড মাঞ্জা দেওয়া নাইলনের সুতো। এগুলি আসার ফলে মানুষের হয়তো শ্রম কমেছে, কিন্তু বদলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। কৃত্রিম এই সুতো শুধু মানুষেরই নয়, পাখিদেরও প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। তাই শান্তিপুরের মানুষের উচিত, পরিবেশ দূষণ ও জীবের বিপদের কথা মাথায় রেখে প্লাস্টিক-বর্জিত উপকরণ দিয়ে ঘুড়ি উৎসবের কথা ভাবনাচিন্তা করা।

শান্তিপুর হরিপুর স্কুলের শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Shantipur Rathayatra Kite
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy