Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

অনাদরে ইতিহাস, সাহেবনগর এখন গন্ডগ্রাম

এক সময় বলা হত পুরী, দার্জিলিং, মধুপুরের থেকেও স্বাস্থ্যকর এখানকার পরিবেশ। প্রভূত পর্যটন সম্ভাবনা নিয়েও আড়ালেই রয়েছে খেজুরি। খোঁজ নিলেন সমীর দাসনদীর চরের বালুরাশি সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ তৈরি করে। আবহাওয়াও সারা বছর মনোরম। নাতিশীতোষ্ণ বাতাসে বিষ নেই!

ভগ্নাবশেষ: খেজুরির সেচ বাংলো। ১৮৩২ সালে তৈরি হয়েছিল এই বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

ভগ্নাবশেষ: খেজুরির সেচ বাংলো। ১৮৩২ সালে তৈরি হয়েছিল এই বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২৩:১৫
Share: Save:

বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ এখানে নেই। তবে বিস্তীর্ণ নদীর কলতান মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। নদীর চরের বালুরাশি সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ তৈরি করে। আবহাওয়াও সারা বছর মনোরম। নাতিশীতোষ্ণ বাতাসে বিষ নেই!

পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি ২ নম্বর ব্লকের পূর্ব-দক্ষিণ সীমানায় ভাগীরথী নদীর মোহনায় পরিবেশ সত্যিই স্বাস্থ্যপ্রদ। খেজুরির ইতিহাসকার মহেন্দ্রনাথ করণের লেখায় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল উপেন্দ্রনাথ মুখপাধ্যায়ের একটি লাইন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। যেখানে তিনি বলছেন, ‘পুরী, দার্জিলিং, ওয়ালটেয়ার, মধুপুরের চেয়েও বেশি স্বাস্থ্যকর খেজুরি’।

খেজুরি যে অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর স্থান তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। সমুদ্র ক্রমশ দক্ষিণে সরে যাওয়ায় তাম্রলিপ্ত বন্দরের পতন ঘটে। সেই সময় ভাগীরথীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে জেগে ওঠে দুটি বৃহৎ চর। ক্রমে সেই চর দু’টিই পরিণত হয় যমজ দ্বীপ—হিজলি ও খেজুরি। মাঝখানে কাউখালি নদী। মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপ দু’টি আবার কুঞ্জপুর খালের মাধ্যমে বিছিন্ন। ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে ডি ব্যারজের মানচিত্রে এই দ্বীপ চিহ্নিত রয়েছে। হিজলি উপকূলে রসুলপুর নদীর মোহনায় নাব্যতা বেশি হওয়ায় এখানে আন্তর্জাতিক বন্দর তৈরি হয়। তখন পাশের দ্বীপ খেজুরিও সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকদের মতে, খেজুরি দ্বীপের একটি বড় খেজুর গাছ নদী থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। সেই গাছ লক্ষ করে নৌকাগুলি যে ঘাটে এসে ভিড়ত, তার নাম হয়েছিল ‘খাজুরি ঘাট’। এই ঘাটের নাম অনুসারেই দ্বীপের নাম হয় ‘খাজুরি’ বা ‘খেজুরি’।

হিজলির নবাব তাজ খান মসনদ-ই-আলার পুত্র বাহাদুরের মৃত্যুর পরে দক্ষিণবঙ্গ সম্পূর্ণ অরাজক হয়ে যায়। ১৬৬৪ সালে স্কাউটেন, ১৬৭৬ সালে স্ট্রিনশ্যাম মাস্টার এবং ১৬৮৩ সালে উইলিয়াম হেজেস খেজুরিতে নেমে গভীর জঙ্গল, সাপ, গন্ডার, বুনো মোষ, বাঘ প্রভৃতি হিংস্র জন্তু দেখতে পেয়েছিলেন। আর জঙ্গলের মাঝে ছিল নবাবি আমলে তৈরি ভাঙাচোরা মাটির দুর্গ। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে জব চার্ণককে বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে হিজলিতে আশ্রয় নেন। সেই সময় পাশের দ্বীপ খেজুরিতে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুদের অত্যাচার এত চরমে উঠেছিল যে জব চার্ণক মন্তব্য করেছিলেন ‘ডেয়ারফুল প্লেস’ বা ভয়ঙ্কর স্থান। তা ছাড়া ছিল মশা ও মহামারির মতো ম্যালেরিয়া রোগ। তখন খেজুরি খুবই অস্বাস্থ্যকর।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে খেজুরির উন্নয়ন শুরু হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। এই সময় ভাগীরথী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে পশ্চিম তীরের গভীরতা বাড়তে থাকে। ফলে, জাহাজ চলাচলের সুবিধা হয়। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের থেকেও এই দ্বীপটি হিজলির থেকে বেশি নিরাপদ ছিল। তাই এখানেই বন্দর তৈরি হয়। ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে দ্রুত লোকবসতি গড়ে ওঠে। কোম্পানির কর্মচারীদের থাকার জন্য স্থায়ী আবাস, নাবিকদের জন্য আলাদা ব্যারাক, পূর্ত বিভাগের কর্মীদের জন্য বাড়ি, হিন্দু কর্মচারীদের সমুদ্রযাত্রার আগে গঙ্গাপুজোর জন্য নির্দিষ্ট উপসনা স্থল, মুসলিম কর্মচারীদের মহরম পালনের জন্য কারবালা ময়দান, তাঁদের থাকার আলাদা বালুবস্তি, দৈনন্দিন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য হাট— একে একে সবই গড়ে ওঠে।

জলদস্যুদের উৎপাত ঠেকাতে কোম্পানি ‘চৌকি নৌকা’র বন্দোবস্ত করেছিল। কোম্পানির বড় বড় জাহাজগুলিও এখানে নোঙর করে ছোট জাহাজে মালপত্র কলকাতা পাঠাত। ১৮১০ সালে রাতে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য আলোক সংকেত দিতে নির্মিত হয় বাতিঘর। একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে রাতে নাবিকদের পথ দেখিয়ে ১৯২৫ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। ৮০ ফুট উঁচু ইটের তৈরি পাঁচতলা বাতিঘরটি থানাবেড়িয়ায় এখনও আছে। তখন বিদেশ থেকে চিঠিপত্রও আসত এই সকল মালবাহী জাহাজে। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে ছোট ছোট দ্রুতগামী নৌকা ওই সব জাহাজ থেকে চিঠিপত্র সংগ্রহ করে কলকাতায় নিয়ে যেত। এই ভাবে ডাক-নৌকা চালু হয়। তৈরি হয় পোস্ট অফিস। খেজুরি তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে ১৮৫১-৫২ সালে সরকার কলকাতা থেকে খেজুরি পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন চালু করে।

‘ভয়ঙ্কর স্থান’ খেজুরি পুরোপুরি বন্দর নগরে পরিণত হওয়ার পরে মশার উৎপাত কমে যায়। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমে। নাগরিক সুবিধা ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর জন্য স্বাস্থ্যকর স্থান হিসাবে খেজুরির খ্যাতি বাড়তে থাকে। যে খেজুরিতে ম্যালেরিয়ার ভয়ে লোকে আসত না, সেই খেজুরিতে ম্যালেরিয়া রোগীরা স্বাস্থ্যোদ্ধারে আসতে শুরু করে। তৈরি হয় পাকা বাড়ি। বহু উচ্চবিত্ত ইংরেজ পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। খেজুরির নাম হয়ে যায় ‘সাহেব নগর’।

যে সমৃদ্ধশালী বন্দর নগরী প্রায় দেড়শো বছর ধরে খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিল, সে-ও প্রকৃতির রোষ থেকে রেহাই পায়নি। ১৮০৭ সালের ১০ মার্চের সামুদ্রিক ঝড়ে খেজুরি বন্দরের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ১৮২৩ সালের ২৭ মে আবার সামুদ্রিক ঝড় ওঠে। সে বার শুধু বন্দরের বিপুল ক্ষতি হয়নি, নদীর গতিপথও পাল্টে যায়। পরে যথাক্রমে ১৮৩১ ও ১৮৩৩ সালে সর্বগ্রাসী বন্যায় খেজুরি বন্দর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পরিণত হয় গন্ড গ্রামে।

মেদিনীপুর জেলা ভাগ হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর গঠিত হওয়ার পরে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা পন্থার খোঁজ চলছে। তার অন্যতম পর্যটন শিল্প। বহু টাকা ব্যয় করে দিঘার মানোন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু খেজুরি অনাদরেই পড়ে। দিঘার পথে হেঁড়িয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে খেজুরির অবস্থান। তবে খেজুরি এখন আর দ্বীপ নেই, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। তাতে অবশ্য প্রায় চারশো বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ম্লান হয়নি। খেজুরির নদী তীরের পরিবেশও আগের মতোই মনোরম, জলবায়ু স্বাস্থ্যকর। খেজুরিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সার্বিক পরিকল্পনা নেওয়া যেতেই পারে। ইতিমধ্যে প্রচুর মানুষ আসছেন শীতের মরসুমে বনভোজন করতে। পর্যটকদের রাত কাটানোর জন্য তৈরি হয়েছে হোম স্টে। ছোটখাটো হোটেলও তৈরি হচ্ছে। সাগরদ্বীপ ঘুরে ডায়মন্ড হারবার থেকে জলপথে ২ ঘণ্টার ভ্রমণ মানচিত্রে আনা যেতে পারে এই খেজুরিকে। আর দরকার খেজুরির ঐতিহাসিক স্থানগুলি চিহ্নিত করে জবরদখল মুক্ত করা। পাশে হিন্দু-মুসলমানের তীর্থ ক্ষেত্র ‘বাবা সাহেবের কোর্টগোড়া তো আছেই হিজলিতে।

সম্ভাবনাময় খেজুরিকে তাই গড়া যায় আলাদা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে, আবার দিঘার সঙ্গে ‘কন্ডাক্টেড ট্যুরে’ও জুড়ে দেওয়া যায়।

লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সহ সচিব

অন্য বিষয়গুলি:

Khejuri Tourism খেজুরি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy