কয়েক জন মানুষ আছেন, যাঁদের সঙ্গে দিনের শুরুতে দেখা হলে দিনটাই ঝকঝকে হয়ে যায়— তাঁদের বোধের, তাঁদের অবিশ্রান্ত সজীব থাকার মাহাত্ম্যে। সেপ্টেম্বরের শেষে এক দিন এক বিশেষ কাজে দেখা হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দেখা হতেই নাটক, দেশ, কাল, সব নিয়ে কথা শুরু করলেন। কথাটা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ছে আজ তাঁরই সাম্প্রতিক একটি কবিতায় পড়া অবিরাম খুঁজে চলা এক মানুষের কথা। “অলক্ষ ভবিষ্যৎ আর অনতিস্পষ্ট স্মৃতির মাঝখান দিয়ে যেতে, যেতে” যে লোকটা বুঝতে পারে “এখন যাপনের অনেকগুলো শব্দই আর কাজে লাগছে না”, তবু সে চলে। যেতে যেতে সে দেখে “শব্দ-অক্ষর-বর্ণমালা থেকে অর্থ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে”— তবু সে খুঁজে চলে, অস্থির ভাবে মাথা নাড়ে, কী যে ছাই খুঁজছে লোকটা! প্রাক্ইতিহাসের স্মৃতি, না কি সীমাহীন কোনও সম্ভাবনার বোধ?
সৌমিত্রবাবুর কবিতায় সে উত্তর নেই। থাকার কথাও নয়। কবিতা তো প্রশ্নের উত্তর নয়, নয় কোনও ব্যাখ্যা বা সমাধানসূত্র। কবিতা একটা অস্থিরতা, যা আমাকে আমাদের সবাইকে খুঁজতে বাধ্য করবে। কী এক দুর্বোধ্য হতাশায়, আমরাও ওই লোকটির মতো বারংবার মাথা নাড়ব ওই অস্থিরতার তাড়সে।
লোকটা হয়তো তার দেশটাকে খুঁজছে। খুঁজছে নিজেকেও। সে দেশে মাত্র কয়েকটা মাসের মধ্যেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী হওয়া একটি রাজনৈতিক দল, প্রতি মুহূর্তে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, ন্যায়, বিচারব্যবস্থা, আইনের শাসন— সমস্ত কিছুকে নিয়ে সে ব্যঙ্গ করছে, ব্যবহার করছে যাকে যে ভাবে খুশি। সেই দেশটা কেমন, সেটার খোঁজ তো করতেই হবে। শাসক যে ভাবে দেশটাকে গড়ে তুলতে চাইছে, সেটা মেনে নিয়ে, মাথাটাকে বিশ্রাম দিয়ে, এক নিরুত্তাপ জীবন কাটানোই যায়; কিন্তু যদি বুঝি মৃত্যু ভিড় করে আসছে চার দিক থেকে, তবে তো না খুঁজে উপায় নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন সঙ্কটকালে কবিতা কী কাজে লাগবে? সে কি অন্ন দেবে? সে কি বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার মূল পান্ডাদের শাস্তি দিতে পারবে? পারবে, হাথরস-এর অত্যাচারিত মেয়েটিকে সুবিচার দিতে? যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা প্রাণ দিলেন রেললাইনে, সড়কে, যে শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ বিজেপি সরকারের তৈরি বিল-এর সৌজন্যে আজ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে, কোন কবিতা এসে পরিত্রাণ করবে তার? শুধু কবিতা কেন? নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, চিত্রকলা— এ সমস্ত কিছুই কি আজ হয়ে পড়ছে না ঠুনকো শৌখিন আসবাবের মতোই বাহুল্যমাত্র?
তবু হঠাৎ যখন পড়ি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের একটি স্মারক বক্তৃতা, তখন দুর্বোধ্য সেই অস্থিরতায় নড়চড়ে বসি। ২০১৮ সালে দেওয়া সেই বক্তৃতার শিরোনাম ‘যুক্তি ও কল্পনাশক্তি’। এই বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু দু’-চার অক্ষরে পড়ার এক অসামান্য অভিজ্ঞতা আমাকে আরও একবার শিখিয়েছে যে, এই মুহূর্তে আমার দেশে এই ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে যদি আমায় পাল্টা একটা লড়াই লড়তে হয়, তা হলে আমরা যারা মনে করছি কোনও রাজনৈতিক দলের নির্দেশিত পথে চলব না, চলব নিজেদের বোধ ও বিবেচনা অনুযায়ী— তাদের কবিতার কাছে ফিরতেই হবে। আরও একটু বড় করে বললে— শিল্পের কাছে। দয়া করে ভাববেন না, এই ভয়ঙ্কর সময়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে কবি বা গায়ক, কিংবা অভিনেতা বা চিত্রকর হতে বলছি। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর বক্তৃতায় আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন কার্ল মার্ক্সের সেই অসামান্য ব্যাখ্যা: ‘‘কাব্য কল্পনা একটি ভবিষ্যৎদর্শী বিপ্লব পদ্ধতি।’’ কেমন সেই কাব্য কল্পনা? গায়ত্রী একটা অসাধারণ উদাহরণ দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কৃষক-মজুরদের ঐতিহাসিক পদযাত্রা প্রসঙ্গে এক স্থানীয় বামপন্থী নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন গায়ত্রী। ওই নেতা যা যা বলেছিলেন, সবটাই শেখানো বুলি। ‘খেতমজুর-কিষান-শ্রমিক’, ‘মহাসমাবেশ’, ‘ঐতিহাসিক সমাবেশ’, ‘জ্বলন্ত ইসু’, ‘লাল ঝান্ডা’, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ ইত্যাদি সব কিছুই সঠিক, কিন্তু ওপর থেকে শেখানো। ঠিক এর পরেই গায়ত্রী শোনাচ্ছেন এক স্কুলশিক্ষিকার কথা, যিনি কোনও দিন ট্রেনে চাপেননি, মাধ্যমিক পাশ, যাঁর স্বামী, ওঁরই ভাষায় এক জন ‘ঘরোয়া ডাক্তার’, যাঁদের একটি ছেলে আছে, যে প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, স্কুলে পড়িয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা কী? তিনি অক্লেশে উত্তর দেন: “অন্যের ছেলেকে কী করে নিজের ছেলের মতো মানুষ করা যায়, এটাই আমি শিখেছি!” এই হচ্ছে কল্পনাশক্তি, অন্য লোককে নিজের মতো করে ভাবতে পারার কল্পনাশক্তি। ভারতীয় জনতা পার্টি তো বটেই, দেশের কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই এই কল্পনাশক্তির চর্চা নেই। আছে শুধু অন্তঃসারশূন্য বক্তৃতা আর গলাবাজি।
তাই আজ রাজনৈতিক বিতর্কে মতামতের সংঘাত বা দার্শনিক সংঘাত হয় না, হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। ভুল বা অন্যায় স্বীকার করার জন্য যে কল্পনাশক্তির জোর লাগে, তার ওপর কোনও রাজনৈতিক দলেরই আস্থা নেই। তাই বিজেপিকে হাথরসের মেয়েটির দুর্দশার কথা বললে তারা বলে, রাহুল-প্রিয়ঙ্কা কেন রাজস্থান যাচ্ছেন না, তোলে পার্ক স্ট্রিট প্রসঙ্গ থেকে কামদুনি প্রসঙ্গ। আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের স্রোতে ভেসে যায় মূল প্রসঙ্গ। কেউ স্বীকার করার সাহস দেখাতে পারে না, জোর গলায় বলতে পারে না— দোষ আমাদের, এই ঘটনার সমস্ত দায়ভার গ্রহণ করলাম। ভবিষ্যতের ওপর কোনও রাজনৈতিক দলের আস্থা নেই। এদের মগজ বোঝাই করা ফন্দি আছে, কোন কথা বললে, কোন কাজটা করলে মানুষের ভাল করার বদলে প্রতিপক্ষকে প্যাঁচে ফেলা যাবে, ভোটে দু’আনা বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে, সেই হিসেব আছে।
গায়ত্রীর ভাষায় যে যুক্তি উন্নাসিক, সেই যুক্তির কাছে নয়— ‘কল্পনা’র কাছে হতে পারে আমাদের আশ্রয়। বলা বাহুল্য, এই ‘কল্পনা’ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, সজীব করে, অর্থবহ করে আমার বেঁচে থাকাকে। ভেবে দেখুন, কী অসামান্য ধূর্ততায় বিজেপি সরকার গণতান্ত্রিক স্তম্ভগুলিতে ফাটল ধরিয়ে দিল অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। বিরোধী-স্বরকে নির্ভরতা দিতে পারে, সাহস জোগাতে পারে এমন একটা ক্ষেত্রকেও অবশিষ্ট রাখল না। জনপ্রিয়তা, অর্থ গ্ল্যামারের নেশায় ভরপুর বলিউডকেও বুঝতে হল, তারাও ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। জেএনইউ কেন, কোনও সরকারবিরোধী আন্দোলনে শামিল হওয়ার সাহস যাতে কোনও চিত্রতারকা কোনও দিন দেখাতে না পারেন, মোদী সরকার সেই ব্যবস্থা পাকা করেছে। মূলস্রোতের শিল্পীদেরও যদি ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যায়, তবে যে সব শিল্পকর্ম খুব বেশি মানুষের সমর্থন পায় না, তাদের দমিয়ে দেওয়া সহজ কাজ।
এইখানেই আসছে আমাদের কথা, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছি, তাদের দায় ও দায়িত্বের কথা। যদি মনে করি সমর্থন বা বিরোধ কোনওটাই কারও শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে করব না, তবে এটাই সঠিক সময়। মার্ক্স বলেছিলেন, ‘এই তো গোলাপ, এখানে নাচো’, এই কথার উৎস ছিল ইশপের গল্পে, যেখানে এক ধাপ্পাবাজ মিথ্যে বড়াই করে বলেছিল, “আমি অবিশ্বাস্য রকম লাফ দিতে পারি, আমি রোডস (Rhodes) বন্দরের এক ধার থেকে আর এক ধারে লাফ দিয়ে পৌঁছতে পারি...” তখন সেই ধাপ্পাবাজকে বলতেই হয়, ওহে মিথ্যেবাদী, রোডস-এ গিয়ে ওস্তাদি দেখাতে হবে না। কল্পনা করো, এটাই রোডস, লাফাও দেখি।
এই সেই কল্পনা, যা এক জন শিল্পীকে রূপান্তরিত করে অন্য এক মানুষে— সত্যি কবে গোলাপ ফুটবে, কবে সব কিছু ঠিকঠাক হবে, তবে আমি কবিতা লিখব, গান গাইব, অভিসার করব, তা হতে পারে না। এই ভয়ানক শক্তির বিরুদ্ধে যদি লড়তে হয়, ফলাফলের কথা না ভেবে এখনই কাজটা শুরু করে দিতে হবে। ছোট আকারে হলেও, যদি এখনও বিশ্বাস রাখি মানুষের ওপর, আমার দেশের দরিদ্র, নির্যাতিত মানুষের ওপর, তাঁরা চিনে নেবেন আমাদের।
আপাতত তবে আস্থা রাখি কল্পনায়, আর অস্থিরতায় ঘাড় নাড়তে থাকি সৌমিত্রবাবুর কবিতায় অবিরাম খুঁজতে-থাকা সেই মানুষটার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy