সাতাশি বছর বয়সি ভুবনবিখ্যাত চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া-র শেষ তৈরি করা চলচ্চিত্র মাদাদায়ো (১৯৯৩) সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। এতটাই ভাল লেগেছিল তাঁর যে, বরেণ্য ওই চলচ্চিত্রকারকে উদ্দেশ করে ওই ছবিটির নির্যাস নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন একটি কবিতা। ওঁর বিখ্যাত লালশালু দিয়ে মোড়া হাতে-বাঁধানো খাতায় লিখে ফেলা ‘জন্মদিন’ কবিতাটি ওঁর কণ্ঠে শোনার অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার।
এমন বহু-বহু বার ঘটেছে। কোনও এক অজানিত কারণে অনেক বার নতুন কবিতা লিখে শুনিয়েছিলেন এমন অনেক কবিতা—হয়তো খুব স্নেহ করতেন বলেই, অথবা বয়সে, ক্ষমতায় অনেকটা কম হওয়া এক উৎসাহী তরুণ অভিনেতাকে নানান ভাবে প্রস্তুত করার তাগিদেই করতেন এমন। কারণ, অভিনেতা তো সে, যে মনে রাখে... আর এই মনে রাখার কোনও শেষ নেই। নিজের সংলাপ, সহ-অভিনেতার সংলাপ, হাঁটাচলা, হাঁটলে, হাঁটবে কেন? বসলে, বসবে কেন? হাতটা উঠলে, কতটা উঠবে, কেনই বা উঠবে, চরিত্রের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, সব, সব সে মনে রাখে...
আমার বাবা প্রয়াত শ্যামল সেনের পর এমন ভাবে হাতে ধরে অভিনয় একমাত্র সৌমিত্রকাকুই আমায় শিখিয়েছিলেন। আর সেই বহুবিধ শিক্ষার মাঝে, আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে ‘জন্মদিন’ কবিতাটি আর কুরোসাওয়া পরিচালিত মাদাদায়ো চলচ্চিত্র... কেমন করে?
সৌমিত্রকাকুর মুখে অত উচ্ছ্বাস শুনে যখন মাদাদায়ো দেখলাম, তখন ওই বয়সে খুবই হতাশ হয়েছিলাম। কোনও কাহিনি নেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অমন জমজমাট প্রেক্ষাপট রেখেও, মূল কাহিনিতে তার কোনও ছাপ নেই। এক জন জাপানি লেখক ও শিক্ষক হায়াক্কেন উচিদা-র জীবন-নির্ভর একটি চলচ্চিত্র। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর জীবন, সেই শিক্ষকের অবসরগ্রহণ, ছোট্ট একটা বাড়িতে বাস, তাঁর প্রিয় পোষ্য এক বিড়ালের হারিয়ে যাওয়া, তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক— ব্যস— এ কি কোনও মহান চলচ্চিত্রকারের বিষয় হতে পারে? তর্ক জুড়েছিলাম আমার ‘শিক্ষক’-এর সঙ্গে। সৌমিত্রকাকু হাসিমুখে শুনেছিলেন আমার যুক্তি। তার পর খুব ধীরে, একটু একটু করে খুলে দিয়েছিলেন জানালাগুলো। যে জানালাগুলোর বাইরে আরও অনেকগুলো জানালা দেখা যায়। আর সেই জানালাগুলোর বাইরে আরও বহু জানালা... আর তার বাইরে।
“লুকোচুরি খেলা চলে ষাট ছুঁলে/ খেলা চলতেই থাকে/ প্রত্যেক মৃত্যুর সংবাদ ডেকে বলে, ‘রেডি’?/ লুকোতে লুকোতে সে বলে ওঠে/ ‘না, এখনও তো নই’...
‘মাদাদায়ো’ শব্দের অর্থ এটাই—‘নট ইয়েট’, ‘না এখনও নয়’। প্রতি বছর হায়াক্কেন উচিদা-র ছাত্ররা তাদের প্রিয় শিক্ষকের সম্মানে জন্মদিনের একটা ছোটখাটো উৎসব পালন করত। সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে তারা বলত, ‘মাধাকাই’— আর ইউ রেডি? আপনি কি প্রস্তুত? এক নিশ্বাসে বিরাট এক গেলাস বিয়ার নিঃশেষ করে প্রৌঢ় শিক্ষক উত্তর দিতেন— ‘মাদাদায়ো’, ‘না, এখনও তো নই’।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমায় বুঝিয়েছিলেন, জাপানে কোন কোন ব্যক্তি জাতীয় সম্পদে পরিণত হন। সিনেমার নায়ক, খেলোয়াড় বা রাজনীতিবিদরা নন, এক জন শিক্ষকও হয়ে উঠতে পারেন তেমন এক সম্মাননীয় জাতীয় সম্পদ, যাঁর দেওয়া শিক্ষায় আলোকিত হয়ে ওঠে সমাজ। আমার শিক্ষক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন তেমনই এক পথপ্রদর্শক, যিনি আমায় শিখিয়েছিলেন সব সময় ঘটনার ঘনঘটা কিংবা তীব্র টানাপড়েন অথবা প্রখর সামাজিক রাজনৈতিক চেতনা-সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র বা নাটক উচ্চমানের শিল্পের একমাত্র নির্ণায়ক নয়। উৎকৃষ্ট শিল্প কখনও, কখনও ভীষণ ব্যক্তিগতও হতে পারে। আর সেই ব্যক্তিগত শিল্পের প্রকাশভঙ্গিও হয় ততোধিক কঠিন এক সাধনা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই শেখা, সংলাপের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, শোনা, বা সহ-অভিনেতার সংলাপ সঠিক ভাবে শুনতে পারার অনুশীলন। আত্মমগ্ন অভিনেতা যা পারে না। সে সারাক্ষণ ‘নিজেকে’ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নানান ভাবে সে নিজেকেই প্রকাশ করতে চায়, ফলে সে ‘চরিত্র’ হয়ে উঠতে পারে না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমন স্বার্থপর বা আত্মসর্বস্ব অভিনয় অপছন্দ করতেন।
ওঁর কাছেই শেখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি (এখনও করে চলেছি) যে, অভিনেতার কাজ ‘নিজেকে’ লুকিয়ে ফেলা। ‘নিজে’ আমি ‘যা’, আমার কাছে যা স্বাভাবিক, যাতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি, সেই সব কিছু লুকিয়ে ফেলা। কারণ আমি ‘যা’, আমার অভিনীত চরিত্র তো ‘তা’ নয়। ‘নিজেকে’ প্রকাশ না করে ‘চরিত্র’কে প্রকাশ করার যে কঠিন দায়িত্ব এক জন অভিনেতাকে নিতে হয়, সেই দায়িত্ব সম্পর্কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আজীবন আপসহীন। ওঁর অভিনীত শেষের দিকে দু’টি চলচ্চিত্রের কথা ভাবুন। ময়ূরাক্ষী এবং বরুণবাবুর বন্ধু। অতনু ঘোষ পরিচালিত
ময়ূরাক্ষী-তে সৌমিত্র এক জন অ্যালঝাইমার্স রোগ-আক্রান্ত নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়। সেই লোকটির চোখের ভাষার সঙ্গে অনীক দত্ত পরিচালিত বরুণবাবুর বন্ধু ছবির জেদি, একরোখা মানুষটির চোখের কোনও মিল নেই। ‘নিজেকে’ চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে পারলেই এটা সম্ভব। মঞ্চেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমন অনেক উদাহরণ তৈরি করেছেন। নীলকণ্ঠ নাটকের কথা ভাবা যাক। জমিদার বাড়িতে আশ্রিত এক অকিঞ্চিৎকর যাত্রা-অভিনেতার চরিত্র। নেশায় ও নারীসঙ্গে চুর হয়ে থাকা জমিদারের নিঃসঙ্গ স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এই বিশেষত্বহীন পুরুষটির। বন্ধুত্ব থেকে ভাল লাগা, শারীরিক সম্পর্ক। জমিদার গিন্নি জন্ম দেন এক কন্যাসন্তানের। কেউ জানে না তার পিতৃপরিচয়। বহু, বহু কাল পর জমিদার ও তাঁর স্ত্রী যখন পরপারে, খাঁ খাঁ করা দেশের ভিটেয় ফিরে এসেছে সেই কন্যা, সঙ্গে সম্ভ্রান্ত স্বামী ও তার চাটুকার বন্ধুরা— সেই জমিদার বাড়িতে তখনও আছে সেই মেরুদণ্ডহীন, অপ্রয়োজনীয় নীলকণ্ঠ। গোটা নাটক জুড়ে নিজেকে তো বটেই, ‘চরিত্র’টিকেও একেবারে আড়াল করে রাখতেন সৌমিত্রকাকু। সকলের ছায়ায় লুকিয়ে ফেলতেন। এটা করতেন সেই দৃশ্যটা মাথায় রেখে— যে দৃশ্যে মেয়েটির স্বামী ও তার চাটুকাররা মদ্যপান করে নীলকণ্ঠকে তাদের আসরের খোরাক করে তুলত, আর অনভ্যস্ত নীলকণ্ঠ মদের নেশায় ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, ঠাট্টায় বিদ্ধ হতে হতে বলে ফেলত যে জমিদার-গৃহে জন্ম নেওয়া কন্যাটির প্রকৃত পিতা সে! এই দৃশ্যটিতে সৌমিত্রকাকু অভিনীত নীলকণ্ঠ তার বহু বছরের চেপে রাখা অপমান, হীনম্মন্যতার খোলস ছাড়িয়ে হয়ে উঠত অনেক ‘বড়’, একটা বৈশাখী মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়ত নীলকণ্ঠ মঞ্চ জুড়ে। এই তীব্রতার কোনও আঁচ বোঝা যেত না গোড়ায়।
খুব সম্প্রতি স্যর পিটার হল (জগদ্বিখ্যাত নাট্যনির্দেশক)-এর একটা লেখা পড়ে চমকে উঠেছিলাম। বইটির নাম ‘এক্সপোজ়ড বাই দ্য মাস্ক’। বইটির মূল কথা কী ভাবে নাট্যশিল্পের সামগ্রিক বিন্যাস ও গঠন এবং ভাষা এক জন অভিনেতার ভাবনা ও বোধকে মুক্তি দেয়। যা আপাতদৃষ্টিতে বাঁধন (‘স্ট্রাকচার’), সেটাই অভিনেতাকে দেয় মুক্তি, দেয় নিজেকে মেলে ধরার ডানা। পৃথিবীর সমস্ত বড় অভিনেতাই সেই চর্চা করেছেন। গ্রিক নাটকে মুখোশের ব্যবহার, শেক্সপিয়রের কাব্য, বেকেট কিংবা হ্যারল্ড পিন্টার-এর বিশিষ্ট ভাষা, মোৎজ়ার্ট-এর ধ্রুপদী অপেরা— এই সব কিছুই সেই বাঁধনেরই উদাহরণ, যার আড়ালে (প্রকৃত অর্থে গুণসম্পন্ন) অভিনেতা আসলে নিজেকে মেলে ধরেন সীমাহীন সম্ভাবনার দিগন্তে।
আমার খুব কাছ থেকে দেখা— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়— আমার শিক্ষককে আমি এই চর্চাতেই নিমগ্ন থাকতে দেখেছি, ফলে নীলকণ্ঠ, রাজা লিয়র, ফেরা, হোমাপাখী, প্রাণতপস্যা কিংবা টিকটিকি নাটকে ওঁর অভিনীত চরিত্রগুলি থিয়েটারের কাঙ্ক্ষিত স্ট্রাকচার ও ফর্ম-এর সমস্ত শর্ত পূরণ করেও হয়ে উঠত জ্যান্ত একটা অভিজ্ঞতা। মুখোশের আড়ালে থেকেও চরিত্রের আসল মুখটা চিনতে পারতাম আমরা।
এক মাসেরও বেশি সময় নার্সিংহোম-এ মৃত্যু এসে তাঁকে বারংবার বলেছে, ‘রেডি?’
তত বারই উনি বলেছেন, ‘না, এখনও তো নই!’
কত জ্বালা, ক্ষয়ক্ষতি, ক্লান্তি, শোক খেলা করছিল বিরল কেশে। তবু মৃত্যু যখন ডেকে ডেকে বলছিল, ‘রেডি?’
তখন সে খেলা ভুলে, অচেতনায় ডুবে, নার্সিংহোমের ঠান্ডা ঘরে দেখেছিল ‘আকাশেতে রাঙা মেঘ নতুন ঋতুর’ ...
বলেছিল, ‘মাদাদায়ো’— ‘না, এখনও তো নই!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy