তিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসটি আসিবার মুহূর্তে ভারতের সকল অঞ্চলের সংবাদবৃত্ত জুড়িয়া বিরাজ করিল একটিই অঞ্চলের উল্লেখ, যাহার নাম কাশ্মীর। স্বাভাবিক। সম্প্রতি সেখানে যে ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে, তাহা অভূতপূর্ব, এমনকি বৈপ্লবিকও বলা চলে। আমূল পরিবর্তনই যদি বিপ্লব শব্দটির অর্থ হয়, তবে অস্বীকার করিবার জো নাই যে বিজেপি-শাসিত ভারতীয় রাষ্ট্র এক টানে কাশ্মীরের সহিত তাহার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাইয়া ফেলিয়াছে। স্বাধীনতা দিবসে বসিয়া এই বিপ্লবের ধরনটি বুঝিবার চেষ্টা করিবার আলাদা গুরুত্ব— কেননা আজিকার কাশ্মীর সঙ্কটের শিকড়টি একেবারে সরাসরি ভাবে উনিশশো সাতচল্লিশ সালের পনেরো অগস্ট হইতে সঞ্জাত। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবল প্রকোপে যখন ভারতীয় উপমহাদেশীয় ভূখণ্ড ভাঙিয়া দুই টুকরা হইতেছিল, সেই সময় ‘দুই জাতি’র কাল্পনিক দ্বন্দ্বের জাঁতাকলের মাঝখানে পড়িয়া গিয়াছিল যে কয়েকটি অঞ্চল, তাহার মধ্যে কাশ্মীরের পরিস্থিতিই ছিল সর্বাপেক্ষা জটিল। এই ইতিহাস এখন আর অজানা নহে যে, সে দিন যে নীতিতে দেশভাগ হইয়াছিল, তদনুযায়ী কাশ্মীরের ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হইবার কথা ছিল না। ব্রিটিশ ভারতের চৌহদ্দিতে কাশ্মীর বলিয়া যে ‘প্রিন্সলি স্টেট’ বা দেশীয় রাজ্যটি বিরাজ করিত, সে রাজ্যের জনসাধারণের অধিক অংশই ছিলেন মুসলিম, কিন্তু শাসক ছিলেন হিন্দু। ইতিহাসের আখ্যানে যাইবার দরকার নাই, মনে রাখা যথেষ্ট যে শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর শাসক ও নেতাদের পছন্দ অনুযায়ী— এবং কাশ্মীরি জনসাধারণের পছন্দ উপেক্ষাপূর্বক— কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিছুটা সাময়িক ভিত্তিতেই সেই সিদ্ধান্ত হয়, কিছুটা অংশ পাকিস্তানের অধিকারে চলিয়া যায়, এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশে কাশ্মীরের ভারতীয় অংশে একটি গণভোটের প্রস্তাবও শোনা যায়। বলা বাহুল্য, সে প্রস্তাব কোনও দিন বাস্তবায়িত হয় নাই। সুতরাং, দেশের একমাত্র মুসলিম-প্রধান রাজ্য হিসাবে, এবং সেই যুক্তিতে দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভ্রান্ত প্রতিপন্নকারী হিসাবে, কাশ্মীর যখন ভারতের অধিগত হইল, সেই সময় কিছু বিশেষ অধিকার তাহাকে প্রদান করা হইয়াছিল।
৩৭০ ধারা নামে খ্যাত সেই বিশেষ অধিকারই স্বাধীনতার বাহাত্তর বৎসর পূর্ণ হইবার প্রাক্কালে রদ হইল। কাজটি ভাল হইল না মন্দ, প্রমাণ করিবে ভবিষ্যৎ। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, ভারতের কাশ্মীর-প্রাপ্তির ন্যায্যতা যেমন সংশয়োর্ধ্ব নহে, তেমন পাকিস্তানও বাহাত্তর বৎসর ধরিয়া যে লাগাতার অনৈতিক কাজকর্ম করিয়াছে ভারতীয় কাশ্মীরে, তাহাও বেআইনি, ও অত্যন্ত আপত্তিকর। ভারত-পাকিস্তানের এই যৌথ রাষ্ট্রিক চাপের মাঝখানে শ্বাসরুদ্ধ হইবার জোগাড় হইয়াছে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের। সাতটি দশক ধরিয়া ওই উপত্যকার প্রায় প্রতিটি পরিবার এক দিকে জঙ্গিবাদ, অন্য দিকে দমননীতির আসুরিক চাপের মধ্যে বাস করিতেছে। স্বাভাবিক জীবনযাপন আজও তাঁহাদের অনায়ত্ত। সত্তর বৎসর, মানে দুইটি প্রজন্ম, ধরিয়া লওয়া যায়। বর্তমান প্রজন্ম কখনও বন্দুকনিশানাবিহীন উপত্যকা দেখে নাই, তাহাও ধরিয়া লওয়া যায়। গত কয়েক দশকে ক্রমাগত জঙ্গিবাহিনীর জনপ্রিয়তা বাড়িবার পিছনে এই দ্বিতীয় প্রজন্মেরই অবদান, অনুমান করা চলে। এমত পরিস্থিতিতে, দিল্লির সংসদে বিল পাশ করিয়া কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করিলেই যে কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্ম এই পনেরো অগস্টের প্রাক্কালে রাতারাতি ভারতীয় নাগরিক হইয়া উঠিবে, এমন আশা বাতুলতা। এক দিকে দেশভাগ, অন্য দিকে কাশ্মীর— দুই প্রবল দুর্ভাগ্যের দরুন পনেরো অগস্ট শুধু স্বাধীনতার দিবস নহে, এক চরম দুর্ভাগ্যের দিবসও বটে। ১৯৪৭ সালের মধ্যরাতের সন্তানরা যাহাই ভাবিয়া থাকুন, ভাগ্যের সহিত সে রাতের গাঁটছড়াটি ছিল বিষকণ্টকে পরিকীর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy