Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
JNU

হম দেখেঙ্গে

ইতিহাস বলছে, যখনই তরুণেরা প্রতিবাদে পথে নেমেছে, রাষ্ট্রশক্তি দমন-পীড়ন নামিয়ে এনেছে। কিন্তু ছাত্র বাহিনীকে দমানো যায়নি। ফৈজ আহমেদ ফৈজের লেখা ‘হাম দেখেঙ্গে’ গানটি এখন দেশ জুড়ে চলা আন্দোলনের অন্যতম বীজমন্ত্র।ষাটের দশকের শেষ দিকে, গড়ে ওঠার সময় থেকেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত।

ঐশী ঘোষ। —ফাইল চিত্র

ঐশী ঘোষ। —ফাইল চিত্র

মল্লারিকা সিংহ রায়
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:১৪
Share: Save:

ষাটের দশকের শেষ দিকে, গড়ে ওঠার সময় থেকেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত। জরুরি অবস্থার সময়ে ছাত্রদের দেশের শাসকের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ, ১৯৮২-৮৩ তে আগুনের ফুলকির মতো ঘটে যাওয়া বিক্ষিপ্ত হিংসাত্মক ঘটনা, নব্বইয়ের দশকে ছাত্রনেতা চন্দ্রশেখরের উজ্জ্বল উপস্থিতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের মুখে মুখে ফেরে। জেএনইউ-এর দৈনন্দিন ছাত্রজীবনে প্রবেশ করার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস ছাত্রছাত্রীরা শোনে তাদের অগ্রজদের কাছে, তাতে এই সব আন্দোলনের মিথগুলিও থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও অ্যাকাডেমিক চত্বর জুড়ে যে হাতে আঁকা পোস্টারের সমারোহ, তাতে ছাত্র সংগঠনগুলির নিজস্ব পরিচয় বিবৃত থাকে। কিছু পটু আর বেশ কিছু অপটু হাতের আঁকা ছোট বড় এই দেয়ালজোড়া প্রদর্শনী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস যেমন বাতলে দেয়, তেমন ভাবেই নানা সামাজিক, রাজনৈতিক বিতর্ককেও বেশ চিত্তাকর্ষক ভাবে উপস্থিত করে। যে ভাবে আন্দোলনের গতিপথ এগিয়ে চলে, দেয়ালে আঁকা মুখগুলিও বদলে যায়, বেড়ে ওঠে। ভগৎ সিংহের ছবির পাশে ছাত্রনেতা চন্দ্রশেখর এবং ক্রমশ তাঁর পাশে রোহিত ভেমুলার মুখ জায়গা করে নেয়। তার পাশে আজও হারিয়ে থাকা নাজিবের মুখ, সদ্য পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন কী ভাবে এগিয়েছে।

আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ফোটোগ্রাফ ঘোরে যেখানে ছাত্রনেতা সীতারাম ইয়েচুরি একটি কাগজ থেকে কিছু একটা পড়ে শোনাচ্ছেন এবং তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে ইন্দিরা গাঁধীও আছেন। মনে হয়, এটি ১৯৭৭-এ ইন্দিরা গাঁধী নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি জানাচ্ছেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ইয়েচুরি। এই ছবি জেএনইউ-র ছাত্র আন্দোলনের একটি দলিল। যা জানায়, ছাত্রসংগঠন এবং কর্তৃপক্ষের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ থাকলেও একে অন্যের মত শোনার পরিসরটি বর্তমান ছিল। জরুরি অবস্থার মতো হিংস্র সময় পেরিয়ে এসেও যে এই পরিসরটি রক্ষা করা গিয়েছিল, ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এইটাই সব চেয়ে বড় উত্তরাধিকার। ১৯৮৩-র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিতে আছে একটি বিপথগামী, কুৎসিত পর্যায় রূপে। এই পর্ব খুব বেশি আলোচিত হয় না। যত দূর জানা যায় যে নড়বড়ে পরিকাঠামো, অপ্রতুল অর্থ এবং কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ভেঙে পড়া সম্পর্কের ফলে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। শিক্ষকদের বাড়ি ভাঙচুর হয় এবং এক বছরের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরবর্তী চার দশকে হয়নি। কেবল গত ৫ জানুয়ারির রাত মনে পড়িয়ে দিয়েছে অনর্থক হিংস্রতা কী ভাবে একটি পঠনপাঠনের আবহাওয়াকে সম্পূর্ণ ধ্বস্ত করে।

১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের ছাত্রী। পড়তে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জেনেছিলাম ১৯৯৭ সালে ঘটে যাওয়া আন্দোলনের কথা। চন্দ্রশেখরের হত্যার পর দিল্লির রাস্তায় ক্রুদ্ধ ছাত্রজনতার ঢল নামা। কী ভাবে তারা পুলিশের লাঠির ঘা সহ্য করে বিহার নিবাসের সামনে পৌঁছয় এবং কী ভাবে বিহার নিবাসের পাহারায় থাকা বিহার মিলিটারি পুলিশের গুলির মুখে পড়ে। দলমত নির্বিশেষে সিনিয়র পড়ুয়ারা ধাবার চায়ের আড্ডায় এই সব কাহিনি আলোচনা করত। আমার ছাত্রজীবনে কবিতা কৃষ্ণান বা আলবিনা শাকিলের মতো ছাত্রনেত্রীদের বক্তৃতা শুনতে যাওয়াটা বেশ একটা উত্তেজনার বিষয় ছিল।

১৯৯৯ সালে পড়তে এসে দেখেছিলাম ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের সহজ সম্পর্ক। আন্দোলনের বিষয় হত নানা দাবিদাওয়া। কিন্তু তা এই সহজ সম্পর্ককে নষ্ট করে দিত না। যে হস্টেলের ওয়ার্ডেন-এর সঙ্গে মেসের খাবারের মান ও মূল্য নিয়ে বাদানুবাদ হয়েছে, তাতে শিক্ষক-ওয়ার্ডেনদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। এবং সেই ওয়ার্ডেনই মধ্যরাতে অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবে অসুস্থ ছাত্রকে নিজে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন।

২০১২ সালে যখন শিক্ষক হয়ে জেএনইউ-এ ফিরে এলাম, তখন সেই সহজ সম্পর্ক আবার গড়ে উঠল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। আমি পাঁচ বছর একটি মেয়েদের হস্টেলে ওয়ার্ডেনও ছিলাম। এক ধাক্কায় দাবি জানানোর দল থেকে দাবিপূরণের দলে পড়ে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কাঠামোর সব চেয়ে নিচুতলার কর্মী হিসেবে এইটুকু বুঝছিলাম, অনেক ন্যায্য দাবি হয়তো মেটানোর ক্ষমতা থাকে না আমাদের পরিকাঠামোয়, কিন্তু আলোচনা করে একটি সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়া যায়।

কর্তৃপক্ষ যদি তা না করে কেবল পালিয়ে বেড়ান ও শেষে কিছুতেই কায়দা করতে না পেরে মিথ্যে অভিযোগে পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে নিয়ে যান, তা হলে ২০১৬ সাল থেকে ক্রমাগত যে ছাত্র-বিক্ষোভ ফেটে পড়ছে, তা চলতেই থাকবে।

অধ্যাপিকা, সেন্টার ফর উইমেন্স স্টাডিজ়, জেএনইউ

অন্য বিষয়গুলি:

JNU Student Movement Student Power Indira Gandhi Sitaram Yechury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy