মহাভারতের যুগে কন্দুকক্রীড়া হয়তো ছিল। মল্লযুদ্ধ, তির-ধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদের খেলা তো ছিলই। ‘ফেয়ার প্লে মেডেল’ বা অমল ক্রীড়া পদক ছিল কি? স্বয়ংবর সভা কিংবা ভারতযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিবৃত্তে ছিল কি তেমন কোনও পুরস্কার?
প্রশ্নটা তুলে দিয়েছে জাপান, সেনেগালকে পিছনে ফেলে বিশ্বকাপ ফুটবলে শেষ ষোলোয় পৌঁছে। মহাভারতকার বিলক্ষণ জানতেন, স্বয়ংবর সভার সীমিত আয়তন হোক বা সমগ্র মহাভারতের আদিগন্ত পরিসর, কোনও ক্ষেত্রেই অমল খেল্ রত্ন পুরস্কার কাউকে দেওয়া সম্ভব ছিল না। জানতেন, দ্রৌপদী যে মুহূর্তে ঘোষণা করেন সূতপুত্র কর্ণ লক্ষ্যভেদ করলেও তাঁর বরমাল্য পাবেন না, তৎক্ষণাৎ খানখান হয়ে গিয়েছিল দ্রুপদকন্যা লাভের জন্য মৎস্যচক্ষু বিন্ধনে ধনীনির্ধন, বর্ণগোত্রনির্বিশেষে যে কারও অংশ গ্রহণের ঘোষিত অনুজ্ঞা। তার আগে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হরণ, কুরুবংশীয় বালকদের অস্ত্রদক্ষতার প্রতিযোগিতা থেকে কর্ণকে দূরে রাখার প্রয়াস, আরও পরে জতুগৃহ-অশ্বত্থামা হত ইতি গজ-কর্ণের রথচক্র গ্রাস-সহ মহাভারত জুড়ে শুধুই তো ষড়যন্ত্র-শঠতা-ক্রূরতা-প্রবঞ্চনা-অমানবতার অনন্ত কলুষপ্রবাহ। সেখানে অমল খেল্ রত্নের ঠাঁই কোথায়?
মানবতার কণ্ঠরোধ থেকে শুরু করে জাতিধর্মবর্ণভেদের অমানবিকতায় দূষিত বর্তমান বিশ্বেও কি তার ঠাঁই থাকার কথা?
হতাশার উত্তর হবে: না, থাকার কথা নয়। তবু যে আছে, সেটা দেখা গেল বিশ্বকাপে জাপানি ফুটবল দলের কৃতিত্বে। ফুটবল-বিশ্বে এশিয়াকে এক ঝটকায় বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার জন্য তো নিশ্চয়ই। সেই ক্রীড়া-মুনশিয়ানার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছেন এবং করতেই থাকবেন দক্ষ ফুটবল-বিশারদেরা। আমজনতার প্রশংসা কিন্তু প্রস্তুত থাকছে জাপানের জন্য। সৎ-সরণি ধরে, ‘এইচ’ গ্রুপের শেষ খেলায় পোলান্ডের কাছে হেরেও তার শেষ ষোলোয় পৌঁছে যাওয়ার জন্য।
এইচ গ্রুপে জাপানের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেনেগালও প্রথম পর্বের খেলায় দিয়েছে চার গোল, খেয়েছেও চার গোল। জাপানও ঠিক তা-ই। পয়েন্ট দু’দলেরই সমান। গোল-সমতা বা গোল-পার্থক্য, যা-ই বলা হোক, তাতেও দুই দল এক অবস্থানে। কারা তবে যাবে প্রতিযোগিতার পরবর্তী ধাপে? যাওয়া উচিত কাদের?
এখানেই নির্ণায়ক ভূমিকা নিল অমলতা। দু’বাহু বাড়িয়ে অভয় নিয়ে এল সে জাপানের কাছে। শুভবুদ্ধি চিন্তাতরঙ্গ পাঠাল জাপানি কোচ আকিরা নিশিনো-র মস্তিষ্কে: গোল করতে পারো না-পারো, গ্রুপের শেষ ম্যাচে পোলান্ডের কাছে একাধিক গোল খাওয়া চলবে না। সর্বোপরি চলবে না কার্ড দর্শন— হলুদ কার্ড দর্শন নয়, লাল কার্ড দর্শন তো নয়ই। অর্থাৎ রক্ষণের চৈনিক প্রাচীর হয়ে ওঠো একাদশ সেনা। আর? আর প্রতিপক্ষকে আঘাত নয় কোনও ভাবেই। কেননা একটি আঘাতই আমন্ত্রণ করে আনতে পারে একটি হলুদ বা একটি লাল কার্ড। তা হলেই সমূহ পতন। কারণ, শেষ ষোলোর পথে নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী সেনেগালের তুলনায় এই একটি জায়গাতেই এগিয়ে আছে জাপান। সেনেগাল হলুদ কার্ড দেখেছে ছ’টি। জাপান চারটি। তুলনামূলক অমলতায় এই সামান্য এগিয়ে থাকাটুকুই আখেরে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে, মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন জাপানের হেডস্যর। হলও তা-ই। বিশ্বকাপে জাপানের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠল সেই ফেয়ার প্লে, অমল, অমলতা।
জাপানি কোচের এই রণকৌশলে হয়তো ছিল নির্ভেজাল গণিত। পাখির চোখ হয়তো ছিল শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, শেষ ষোলোর এক্সপ্রেসে পা রাখার জায়গা করে নেওয়া। কোচের এই রক্ষণাত্মক রণনীতির জন্য সে দিন জাপানি ফুটবলারদের প্রভূত বিদ্রুপ-টিটকিরি সইতে হয়েছে মাঠে। আগ্রাসী লড়াইয়ের উত্তেজক মদিরার অভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে মহার্ঘ টিকিট কেটে মাঠে ঢোকা দর্শকের একাংশকে।
কিন্তু জাপানি কোচ যা করলেন, যা করালেন তাঁর এগারো জন সৈনিককে দিয়ে, তা বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিবৃত্তে স্বতন্ত্র অধ্যায়ের দাবিদার তো বটেই। বিশ্বজোড়া হননক্রীড়ার ময়দানেও সেটা মানবতার এক অভিনব পাঠ। আত্মরক্ষা, কিন্তু আঘাত নয়। খেলা, কিন্তু অনৈতিকতা নয়। অমলতাই শেষ আশ্রয়। অন্তিম অবলম্বন। এই মন্ত্রেও যে এগোনো যায়, এই মন্ত্রেই যে এগোনো উচিত, সেই শিক্ষা, সেই মহাশিক্ষকতা সম্পন্ন করলেন জ়েন-কাব্যের দেশ, উদিত সূর্যের দেশের ফুটবল দ্রোণাচার্য আকিরা নিশিনো।
বিশ্বকাপ অভিযানে শেষ ষোলোর গাঁট পেরিয়ে শেষ আটে জাপান পৌঁছতে পারুক, না-পারুক, বিশ্বকাপ টোকিয়োয় শোভা পাক বা না-পাক, প্রতিযোগিতার মাঝ পথেই ‘ফেয়ার প্লে ট্রফি’ পেয়ে গেল জাপান। অমল খেল্ রত্ন হয়ে উঠলেন নিশিনো।
সেই সঙ্গেই জাপানি কোচ প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন: জীবনযুদ্ধের পাঠ্যক্রম থেকে ‘অল ইজ় ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ বা ‘দ্য রুলস অব ফেয়ার প্লে ডু নট অ্যাপ্লাই ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ আপ্তবাক্য বিসর্জন দেওয়ার সময় কি হল?
বিশ্ব রাজনীতির পাঠ্যক্রম প্রণেতারা, ভূগোলক নিয়ে নিরন্তর রক্তাক্ত কন্দুকক্রীড়ায় মত্ত বিরাট শিশুরা ভেবে দেখবেন নাকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy