রোজা পালনের প্রথা বহু যুগ ধরে একাধিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। ফাইল চিত্র।
‘খুশিতে মাতোয়ারা সকল মুমিন, এসেছে রমজান শান্তির দিন...’। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। হিজরি অব্দের মাসগুলির মধ্যে রমজান নবম মাস। এই মাসটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে এবাদতের মাস। এই মাসে কোরান নাজেল হয়েছিল। ‘রোজা’ শব্দটি ফার্সি। আরবিতে রোজাকে ‘সিয়াম’ বলা হয়। এই সিয়াম বা রোজার অর্থ, সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি না খেয়ে উপবাসে থাকা নয়। রমজান হল সংযমের মাস। সমস্ত লোভ-লালসা, পাপাচার, কামনা-বাসনা, ভোগবিলাস থেকে বিরত থাকার মাস। ধর্মের বিধান অনুযায়ী, প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের রোজা রাখা অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য।
রোজা শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল, কোনও কিছু থেকে বিরত থাকা। ‘সিয়াম’ শব্দের অর্থও তাই। এই যে ৩০ দিন রোজা রাখার বিধান, এর কারণ হল, বেহেস্তে থাকাকালে শয়তানের প্ররোচনায় ও বিবি হাওয়ার আবদারের ফলে কয়েক মুহূর্তের জন্য হজরত আদম বোধবুদ্ধি রহিত হয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করে ফেলেছিলেন। পর ক্ষণেই আদম তাঁর ভুল বুঝতে পেরে বার বার ‘তৌবা’ করতে থাকেন। আল্লাহ্ পাক ৩০ দিন পর আদমের ‘তৌবা’ কবুল করেন। এই জন্যই আদমের সন্তানদের ওপর ৩০ দিন রোজা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
রোজা পালনের প্রথা বহু যুগ ধরে একাধিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। হজরত নুহ শুধু দুটি দিন বাদ দিয়ে সারা বছর রোজা রাখতেন। শোনা যায় হজরত ইব্রাহিমের সময়েও ৩০ দিন রোজা পালন করা হত। মুসলিমরা ১০ মহরম আসুরার দিন রোজা রাখেন। একসময় পর্যন্ত ইহুদিরাও আসুরা পালন করত। তবে তা নিজেদের হিসেব অনুযায়ী। ওরা হিজরি অব্দের সপ্তম মাসের ১০ তারিখে আসুরা মেনে রোজা রাখত।
রোজা রাখার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যেমন মুসলিম হওয়া, সাবালক হওয়া, শারীরিক দিক দিয়ে সক্ষম হওয়া ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব থেকে বিরত থাকা। রোজার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলি হল, রোজা রাখার জন্য সঙ্কল্প করা বা নিয়ত করা, সমস্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা এবং যৌন আচরণে লিপ্ত না হওয়া। রোজা দিনের বেলা রাখার নির্দেশের কারণ, রাত আরামের জন্য, তাই যাতে মানুষ ইফতারের পর নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করতে পারে।
রমজান মাসে সারাদিনের উপবাসের পর ইফতার পার্টির এই ছবি দেখা যাচ্ছে না এ বছর। ফাইল চিত্র।
যুগে যুগে স্বার্থান্বেষী মানুষের ভুলভাল ব্যাখ্যার কারণে ও কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ইসলাম ধর্মকে সবসময়েই কাঠগড়ায় তুলতে চেয়েছে। সহজ ভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবলে দেখা যাবে ইসলাম সাম্যের ধর্ম। মুসলিমদের প্রতিটি উৎসবের অঙ্গ কৃচ্ছসাধন, সংযম, দান বা সমবণ্টন। ফিতরা ও জাকাত না দিলে রোজা সম্পূর্ণ হয় না। রোজা না রাখলেও বাড়ির প্রত্যেক সদস্য প্রতি ফিতরা দিতে হয়। ফিতরা হচ্ছে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যদ্রব্যের মূল্য যা রমজান মাসে দরিদ্রদের দান করতে হয়। প্রথম দিকে খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হত। যেমন গম, খেজুর, কিশমিশ ইত্যাদি। ওজন কিন্তু একই থাকত। ধীরে ধীরে স্থান, কাল, পাত্র পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে গিয়েছে খাদ্যবস্তু দেওয়ার নিয়ম। এখন উভয়পক্ষের সুবিধার্থে ফিতরা হিসেবে টাকা দেওয়া হয়। এই টাকার প্রথম হকদার গরিব আত্মীয়রা, তার পর প্রতিবেশীরা, তার পর দূরের মানুষ। এই ফিতরার টাকা অন্য কোনও কাজে দান করা যাবে না।
রমজানে ধনবান ব্যক্তিদের জাকাত দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। প্রতি বছরের আয় ও সম্পত্তি যদি শরিয়ত মতে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে তবে তার সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তির একটা অংশ গরিবদের মধ্যে দান করতে হয়। এটি একটি ইসলামের নৈতিক নিয়ম বা ব্যবস্থা। যা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। অর্থবান মানুষের মধ্যে কৃপণতা (ব্যতিক্রমী মানুষও আছেন) ও সঞ্চয় বাড়ানোর প্রবণতার কারণে এঁরা স্বেচ্ছায় কাউকে দান করতে চান না। কিন্তু ধর্ম মেনে চলতে হলে জাকাত তাঁকে দিতেই হবে। সঞ্চিত অর্থ, সোনা ও রূপোর গহনা, গবাদি পশু ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ অর্থ জাকাত দিতে হয়।
ইদের নামাজের এই ছবি এ বছর দেখা যাবে না। ফাইল চিত্র।
জাকাতের অর্থ পাওয়ার যোগ্য একেবারে যারা ভিখারি অথচ ইমানদার, যে মেয়ের বিয়ে দিতে বা জমির কর্জ চুকাতে পারছে না, তালাকপ্রাপ্ত বিধবা ও অনাথ ছেলেমেয়েরা, পঙ্গু অক্ষম ব্যক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিধর্মীদের জাকাত দেওয়ার নির্দেশ নেই। তবে তারা যদি ইসলামে বিশ্বাস আনতে চায় তখন তাদের জাকাতের টাকা দেওয়া যেতে পারে। তবে বাস্তবে ফিতরার টাকাই গরিবদের দিতে দেখা যায়। জাকাতের টাকা সাধারণত মাদ্রাসা, মসজিদে দেওয়া হয়। অনেকে দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের ও দুঃস্থ কন্যার বিয়েতে জাকাতের টাকা দান করে থাকেন। এই জাকাতের টাকা আদায় করা অনেকের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রসিদ বই নিয়ে এরা দূর দূর জেলার গ্রামে শহরে মসজিদ মাদ্রাসার জন্য জাকাতের টাকা আদায় করে ফেরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরা ভেকধারী হয়। তা ছাড়া এরা কখনও স্কুল নির্মাণের কথা বলে না।
আরও পড়ুন: যুক্তি না মানলে কোনও মঙ্গলময়ের ক্ষমতা নেই এই অন্ধকার দূর করার
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আক্রমণের কারণে এ বারের রমজান একেবারে অন্য রকম ভাবে পালন করা হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সর্বত্র। করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সব রকম জমায়েত বন্ধ। ইসলামে ‘জামাত’ (তবলিগ জামাত নয়) ব্যাপারটি খুব ভাল। যেমন, জামাতে নামাজ পড়া, জামাতে খাওয়া ইত্যাদি। জামাতে নামাজের সময় সাম্যের ব্যাপারটি বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। ধনী-গরিব সবাই এক কাতারে বা আগে-পিছে নামাজ পড়ে। রোজার সময় সেহেরি (ভোরের খাবার) সবাই বাড়িতে করলেও পুরুষ মানুষেরা বেশির ভাগই মসজিদে সবাই একসঙ্গে (জামাতে) ইফতার করেন। কেউ কিছু খাবার নিয়ে যেতে না পারলেও খাবারের অভাব হয় না। সবার নিয়ে আসা খাবার একসঙ্গে ভাগ করে খাওয়া হয়। সেটা লকডাউনের জন্য সম্ভব হচ্ছে না। এই সময় কলকাতার বিভিন্ন রাস্তার ধারে ইফতারের খাবার বিক্রি হয়। সুস্বাদু হালিম বিক্রি হয়। এ বার সেটাও বন্ধ। মানুষ তো বাইরে বার হতে পারছে না।
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যব্যবস্থাতেই হোক রাষ্ট্রের প্রধান মনোযোগ: রণবীর সমাদ্দার
মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতেই হবে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে খুব ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সবার প্রথমে আমাদের জীবনঘাতী এই ভাইরাস থেকে বাঁচার কথা ভাবতে হবে। ইসলামেও বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজেদের বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে বলা হয়েছে। তাই জাকাতের টাকা যদি একত্রিত করে করোনা মোকাবিলায় লাগানো যায়, তার থেকে ভাল কিছু হয় না। এ ভাবে ফিতরার টাকাও ধর্ম না দেখে মানুষটির প্রয়োজন দেখে দেওয়া উচিত। গরিবের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বা জাত হয় না। পৃথিবীতে দু’টিই জাত আছে, ধনী আর দরিদ্র। এ ভাবে ভাবলে রমজানের আনন্দ বাড়বে বই কমবে না। এই সংযম ও ত্যাগের মাসে সবার জন্য রইল একরাশ শুভকামনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy