যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে স্নাতক স্তরে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হই ২০০৮-এর জুলাইয়ে। ক্লাস শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যেই আর্টস বিল্ডিংয়ের দোতলায় টমাস পেন-এর ‘দ্য রাইটস অব ম্যান’ নিয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে একতলায় ডিনের অফিসের সামনে চলা তুমুল স্লোগান কানে আসতে থাকায় ক্যাম্পাসের আগুনে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আঁচ পেয়ে গিয়েছিলাম। তার পরে ছাত্র-গবেষক হিসেবে তো বটেই, অনিয়মিত ভাবে ছাত্র রাজনীতি করার দরুনও গত দশকের অনেকটা সময় জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অশান্ত সময়ের সাক্ষী থেকেছি।
ক্যাম্পাসে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনও নতুন কিছু নয়। ২০১৬ সালেও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যাদবপুরে হামলা চালানোর চেষ্টা করে একটি ছবি দেখানোকে ঘিরে। তার পরেও বাইরে থেকে আসা বিরাট মিছিলে থাকা হিংসাত্মক ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে মানবশৃঙ্খল গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষকশিক্ষিকারা। তবে গুন্ডাবাহিনীর দলগত পরিচিতি নিয়ে লুকোছাপা ও চক্ষুলজ্জা এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও এ বার কলকাতা ছেড়ে আমেরিকা ফিরেছি নিজের প্রিয় শিক্ষাপ্রাঙ্গণ ঘিরে গভীর উদ্বেগ নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপির তাণ্ডবই একমাত্র কারণ নয়, তার পরেও যাদবপুরের সহকর্মীদের নিয়ে নামজাদা নেতারা যে জঘন্য ভাষায় কথা বলছেন তাতে মনে হয় এ দেশে রাজনীতির প্রতিহিংসাপরায়ণতাও এক অতুলনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে।
এর সঙ্গে সঙ্গেই উস্কানি দেওয়া হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের ন্যারেটিভকে, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি ও ফেসবুক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে করিতকর্মা সাইবারগুন্ডারা যে ন্যারেটিভ দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের (একদা সুপ্ত ও আজ নব্য) রক্ষণশীলতাকে আকর্ষণ করেছে। ন্যারেটিভটি এই: যাদবপুরের এই ‘লক্ষ্যহীন এবং শৃঙ্খলাহীন পরিবেশ/রাজনীতি’ নাকি অ্যাকাডেমিক মান হ্রাসের সূচক। লক্ষণীয়, ‘অ্যাকাডেমিক মান হ্রাস’-এর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কৌতুকপূর্ণ বক্তব্যের সঙ্গে প্রায়শই জুড়ে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা শিক্ষার্থীদের ‘উদারপন্থী’ জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য ও কুরুচিকর ঈঙ্গিত: ‘‘যাদবপুর! আরে ওখানকার ছেলেমেয়েরা বাপমায়ের বখে যাওয়া সন্তান, খালি গাঁজা খায় আর ছোট জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়, ওখানে তো পড়াশোনা ছাড়া আর সব হয়, তাই সারাক্ষণ গন্ডগোল।’’
ভয়ের বিষয় এই যে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ মানুষেরাও এই প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে যুক্তিসম্মত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম হতে পারেন না। তার একটা কারণ বোধ হয় অতীতচারণায় ডুবে থাকা এক ধরনের রোম্যান্টিক আদর্শ: ‘‘আমাদের সেই যুগটাই ভাল ছিল।’’ এই ভাবেই আমরা উল্টো দিকের আগ্রাসী ও উগ্র ন্যারেটিভকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি না তো?
এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা দরকার। যাদবপুরের শিক্ষাগত মান গত কয়েক বছরে হ্রাস পেয়েছে, এটা বলা সত্যের প্রবল অপলাপ বই আর কিছু নয়। এই প্রতিষ্ঠান এখনও দেশের সেরা পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চলে আসবে। বিগত কয়েক দশক ধরে ভারতের রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে তুলনামূলক ভাবে যে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে তা বিবেচনা করে দেখলে যাদবপুরের এই ফলাফল এক অবাক করা কীর্তি। এই র্যাঙ্কিংয়ের দিকে তাকানোর সময় এটাও ভাবা দরকার যে প্রথাগত ভাবে এগিয়ে থাকা আইআইটিগুলিতে পড়ানোর বিষয়বৈচিত্র অনেক রাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের থেকে কম। চারটি শাখার বিভাগসমূহ, ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্কুল এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলির সংখ্যা যোগ করলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট অ্যাকাডেমিক ইউনিটের সংখ্যা স্বচ্ছন্দে জেএনইউ-কেও ছাড়িয়ে যাবে। জাতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে যাদবপুর বরাবরই চিরাচরিত আন্ডারডগ-এর তকমা বয়ে বেড়িয়েছে বিপুল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবং মেধাতন্ত্রের ক্লান্তিকর সাফল্য-ব্যর্থতার বাইনারি অতিক্রম করে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে যাদবপুর তৃতীয় বারের জন্য ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (ন্যাক) দ্বারা পরীক্ষিত হয় এবং ৩.৬৮ রেটিং পেয়ে জেএনইউ, হায়দরাবাদ ও টিআইএসএস-এর মতো সেরা পারফর্মারদের বৃত্তে চলে আসে। এই শিরোপাই পরে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠানকে এলিট কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্যপ্রাপ্তদের তালিকাভুক্ত হতে সাহায্য করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক-এ ২০১৭ সালে প্রথম বার দরখাস্ত করেই যাদবপুর দেশের সেরা পাঁচটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জায়গা করে নেয়। দশটি রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করে গড়ে তোলা ‘রুসা’র (রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান) এক নির্দিষ্ট প্রকল্পের আওতায় যাদবপুর ২০১৮ সালে ১০০ কোটি টাকা সাহায্যের জন্য মনোনীত হয়, যা ন্যাক-এর থেকে উঁচু রেটিং পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য নির্ধারিত ছিল। এই ফান্ডের সঠিক বিতরণ ও ব্যবহারের নিরিখেও গত এক বছরে যাদবপুর ভাল কাজ করে এক বিরল ব্যতিক্রম।
নিঃসন্দেহে এর থেকে অনেক বেশি চর্চা হয়েছে অনেক টানাপড়েনের পর এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইউজিসি–র দেওয়া ইনস্টিটিউশন অব এমিনেন্স তকমা নিয়ে। এ ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে কেবলমাত্র যাদবপুর ও তামিলনাড়ুর আন্না ইউনিভার্সিটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। যে হাজার কোটি টাকার অঙ্গীকার কেন্দ্রের পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা যদি সত্যিই সামনের পাঁচ বছরে সময়োপযোগী ভাবে বিতরণ ও সদ্ব্যবহার করা যায় তা হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আর্থিক বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আশ্চর্যের কথা এই যে, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি প্রকাশ পাওয়া ইনস্টিটিউশন অব এমিনেন্স-এর ভিশন ডকুমেন্টে ঢাকঢোল পিটিয়ে শিক্ষার উৎকর্ষের মান বাড়ানোর কথা লেখা থাকলেও আদতে এই হাজার কোটি টাকার কোনও অংশই নাকি নতুন পদ সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। সমস্যার মূলেই যদি না যাওয়া হয় তা হলে কিন্তু এই অর্থবৃষ্টির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। এর পাশাপাশি এটা ভুলে গেলেও চলবে না যে, এই অর্থ পেতেও বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার নয়াদিল্লির উদ্ধত ও অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষ ‘বাবু’দের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেকটা সেই কারণেই গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর খবর ছাপা হয়েছে। ২০১৭ সালের ইউজিসি নির্দেশিকা মারফত প্রথমে ভাবা হয়েছিল যে, অর্থসাহায্যের এই প্রকল্পে রাজ্য সরকারের বিশেষ ভূমিকা নেই, পুরো টাকাটাই আসবে কেন্দ্র মারফত। অথচ কিছু দিন আগেই রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক থেকে চিঠি আসে এই মর্মে যে, যদি রাজ্য সরকার তিন হাজার কোটি টাকার দুই-তৃতীয়াংশ দিতে পারে তবেই কেন্দ্র হাজার কোটি টাকার সাহায্য করতে পারবে। ঘটনাপ্রবাহের এই নতুন মোড় বিভ্রান্তিকর, কারণ এই তিন হাজার কোটি টাকার অঙ্ক দিল্লির আমলারা কোথা থেকে পেলেন তা ব্যাখ্যা করা নেই।
প্রসঙ্গত, ক’জন জানেন যে, এত সমস্যার মধ্যেও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত খবর অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক? জানি না, কারণ সংবাদটি খবরের কাগজের সাতের পাতার এক কোণেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে যাদবপুরের আপাত-নৈরাজ্য ও অধঃপতন নিয়ে গেল গেল রব সন্ধেবেলার টিভি প্যানেলের জন্য মুচমুচে উপাদান। আজকের ইমেজস্নাত সময়ে আবেগপূর্ণ প্রতিবাদের প্রদর্শনীর আকর্ষণ ফেলে দেওয়ার মতো নয়, বরং জনমত বদলাতে তা অবিশ্বাস্য ভাবে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি সম্পর্কে সচেতনতা এই ‘ধ্বংসাত্মক যাদবপুর’ মার্কা গালগল্পকেও নাকচ করতে সাহায্য করতে পারে বলেই মনে হয়।
সত্যি বলতে কি, তথাকথিত প্রতিষ্ঠানপন্থী ন্যারেটিভের বিপরীত স্রোতে হেঁটেই যাদবপুর বরাবর তার ইতিহাস গড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এক সময় প্রথাবিরুদ্ধ ভাবে জাতীয়তাবাদী ছিল, যখন ভারতের উচ্চশিক্ষায় সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের ধামাধারীরা এই ‘নেটিভিস্ট’ প্রতিষ্ঠানকে দেখে নাক কুঁচকেছেন। সমালোচকরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন বিপ্লবীদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন তখনও তার কিছু যায় আসেনি। আনুষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার ‘যোগ্যতা’ না থাকা সত্ত্বেও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ শতকের অন্যতম সেরা বাঙালি কবিকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় তার অর্থনীতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে এক ২৫ বছরের অধ্যাপককে নিযুক্ত করে। অনেক সমালোচনা, অনেক উপহাসের নিশানা এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতেই থেকেছে, কারণ তার বাতাবরণের মধ্যে চলা চিন্তার স্রোতের বৈচিত্র ও নিরন্তর অস্থিরতা। যাদবপুর কখনওই শুধুমাত্র কলকাতার ‘আর একটি ইউনিভার্সিটি’ ছিল না, বরং আমাদের এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে পড়তে আসা অসংখ্য স্বপ্নসন্ধানীর কাছে ছিল এক ‘গেটওয়ে’ ইউনিভার্সিটি— মুক্তচিন্তার প্রবেশদ্বার।
এত সহজে গোল্লায় যাব না আমরা। ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ হলেও না।
লেখক: গবেষক, ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্টা বারবারা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy