ছাত্রছাত্রীরা ইচ্ছা করিলেও স্কুলে নিজের খাবার নিজে আনিতে পারিবে না, এমন বিধান শুনিলে বিস্ময় স্বাভাবিক। ইটালির সুপ্রিম কোর্ট কার্যত এমন রায়ই ঘোষণা করিয়াছে। তাহার বক্তব্য: স্কুল হইতে খাবার না লইয়া নিজস্ব খাবার আনিবার অধিকার শর্তহীন নহে, ছাত্রছাত্রীদের সেই স্বাধীনতা দেওয়া হইবে কি না, তাহা স্কুলের পরিচালকরাই স্থির করিবেন। অর্থাৎ কোনও স্কুল ইচ্ছা করিলে বলিতেই পারে, স্কুলে বাড়ির খাবার আনা চলিবে না। অনেক অভিভাবকই এই রায়ের প্রতিবাদে মুখর। তাঁহাদের প্রধান অভিযোগ, স্কুলের খাবার অনেক সময়েই রুচিকর বা স্বাস্থ্যকর নহে, তদুপরি তাহার দাম অত্যধিক, কখনও বা সাধ্যাতীত। অস্বাস্থ্যকর, অরুচিকর বা দুর্মূল্য খাবার না কিনিলে স্কুলে খাওয়া চলিবে না, এমন বিধান অবশ্যই অযৌক্তিক। কিন্তু স্বাস্থ্যকর, রুচিকর এবং সুলভ হইলেও, এমনকি নিখরচায় মিলিলেও স্কুলের খাবার খাইতেই হইবে, এই নিয়মও কি যুক্তিসঙ্গত? ন্যায়সম্মত? এই জবরদস্তি কি মৌলিক ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী নহে? ইটালিতে তর্ক চলিতেছে।
আদালতের যুক্তি: ছাত্রছাত্রী স্কুলে আপনার খাবার আপনি আনিলে ‘আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে সমতা এবং নিষ্পক্ষতার নীতি লঙ্ঘিত হইবার সম্ভাবনা থাকে।’ অস্যার্থ— যাঁহারা তুলনায় সম্পন্ন তাঁহারা আপন সন্তানকে মহার্ঘ খাদ্যসামগ্রী দিয়া স্কুলে পাঠাইবেন, তাহাতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্যবোধ তৈয়ারি হইতে পারে। পঙ্ক্তিভোজনে যে সাম্যের চেতনা তরুণ মনে নিষিক্ত হয় তাহাই আদর্শ। কথাটি উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। স্কুল নিছক পড়া তৈয়ারি করিবার জায়গা নহে, জীবনবোধ শিক্ষার পরিসরও। আধুনিক সমাজে শিশু-কিশোরদের মানসিকতা গড়িয়া উঠিবার ক্ষেত্রে স্কুলের অবদান হয়তো পরিবার অপেক্ষাও অধিক, বিশেষত এই কারণে যে, ছোট পরিবারের নিঃসঙ্গ শিশুদের সমবয়সিদের সহিত নিয়মিত সময় কাটাইবার প্রধান অথবা একমাত্র সুযোগ স্কুলেই মিলে। দৈনন্দিন জীবনচর্যায় সমতার বোধ অবশ্যই শিক্ষণীয়। বিচ্ছিন্ন দিনযাপনের এই যুগে অনেক শিশুরই বন্ধু বলিতে আপনার অনুরূপ সামাজিক পরিমণ্ডলের অধিবাসী সমবয়সিরা, অন্য শ্রেণি বা বর্গের শিশুদের সহিত মেলামেশার কোনও অবকাশই নাই আর। স্বভাবতই, তাহাদের অনেকের মনেই সামাজিকতার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। অনেকের আচরণেই তাহার প্রতিফলনও ঘটে— অন্যের প্রতি, অন্য বর্গের প্রতি সহমর্মিতার বোধ এই সমাজে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর।
যে যাহার আপন খাবার না খাইয়া সকলে এক সঙ্গে একই খাবার খাইবার অভ্যাস এই সামাজিকতার একটি সহজ স্বাভাবিক অনুশীলন হিসাবে মূল্যবান। এ দেশে স্কুলে মিড ডে মিল প্রকল্পের অভিজ্ঞতাতেও এই স্বাভাবিক যৌথতার অনেক কাহিনি নিহিত আছে। অর্থাৎ, ইটালির আদালতের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি সাধু। কিন্তু সাধু উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা কত দূর বিসর্জন দেওয়া যায়, প্রশ্ন সেখানেই। সম্ভবত, উদ্দেশ্য ও বিধেয়র এই দ্বন্দ্ব নিরসনের সদুপায় একটিই। ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের সহিত মুক্ত আলোচনার পথে যৌথতার মানসিকতাটিকে জাগ্রত করিবার চেষ্টা। সেই চেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তবে ‘বিচ্ছিন্ন’ থাকিবার দাবিকেই মানিয়া লওয়া বিধেয়। ব্যক্তিস্বাধীনতা শিরোধার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy