বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। ছবি: এএফপি।
জম্মু-কাশ্মীরের নতুন রাজ্যপাল নিয়োগ হল। ’৬৫ সালে কর্ণ সিংহ কাশ্মীরের রাজ্যপাল হন। তার পর থেকে আর কোনও রাজনৈতিক নেতা কাশ্মীরের রাজ্যপাল হননি। এ বার সত্পল মালিক কাশ্মীরের রাজ্যপাল হলেন। তিনিও আমলা বা প্রাক্তন আমলা নন। সেনা অফিসারও নন। তিনি আগে ছিলেন সমাজতন্ত্রী। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। পরে অবশ্য জনতা দল থেকে কংগ্রেস, তার পরে বিজেপিতে এসেছেন।
মালিক বলেছেন, তিনি কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় জোর দেবেন। শুনতে এ কথা আমাদের খুব ভাল লাগছে। আবার মালিক এ কথাও বলেছেন, তিনি তো ম্যাজিক জানেন না যে একটা জাদুছড়ি দিয়ে তিনি সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন, যা আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি!
আমার প্রশ্ন একটাই, আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার যখন ধর্মকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে, এমনকি জাম্মুতেও জনউদ্দীপনা তৈরি করতে চাইছে, তখন কী ভাবে কাশ্মীরের জট ছাড়ানো সম্ভব হতে পারে? কাশ্মীরি জনগণের লড়াইকে সর্বদাই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম পাকিস্তানি ইসলামিক ধর্মশাসনের মধ্যেকার লড়াই হিসেবে দেখানো হয়। চাপিয়ে দেওয়া হয় সরকারি জাতীয়তাবাদ।
কাশ্মীরিদের সংগ্রাম তাদের স্বশাসন লাভের লড়াই। দিল্লির ধারণা যদি হয়, কাশ্মীরি আন্দোলন মানেই জাতি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এক ধর্মান্ধ ইসলামি সন্ত্রাস! অতএব, গোটা পৃথিবী জুড়ে যে সন্ত্রাস চলছে কাশ্মীর তার একটা অঙ্গ। অতএব, সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে কাশ্মীরে ডাণ্ডা দিয়ে ঠান্ডা করার কৌশল নিতে হবে!
নতুন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক পারবেন কি আস্থা ফেরাতে?
আমার মনে হয়, আমরা যত দিন এই ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকবো, তত দিন কাশ্মীর সমস্যার সমাধান তো হবেই না, উল্টে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হবে। ভারত তো পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচ গুণ বড় আয়তনে। পাকিস্তান আর চিনের সঙ্গে একইসঙ্গে যুদ্ধ করার হিম্মত নাকি আমরা রাখি। তা এ হেন সামরিক শক্তিকে নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ, তবু ঘোলা জলে মাছ ধরা থেকে ভারতীয় প্রশাসন পাকিস্তানকে বিরত রাখতে পারছে না কেন? আবার অন্য দিকে, কাশ্মীরি মানুষের সঙ্গে ঐকমত্য গড়ে তুলতেও তো সরকার ব্যর্থ হচ্ছে! ১৯৯৮ সাল থেকে একটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটা হল, ভারতীয় সংসদীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাশ্মীরে প্রতি বার ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ভোট বয়কট করে! ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল শ্রীনগরে একটা আসনে উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ মানুষ ভোট বয়কট করে। যে ৭ শতাংশ ভোট গৃহীত হয় তার মধ্যে আবার তৃতীয় স্থানে আছে এনওটি— অর্থাৎ নন অফ দ্য অ্যাবাভ! তার মানে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে, ভারতের প্রতি সেখানকার মানুষের ভিত যে ক্ষয় পেয়েছে, ভারতের উপর বিরক্তিতে ভোট বয়কটের হার যে বৃদ্ধি পেয়েছে তা তো স্পষ্টতই লক্ষ করা যাচ্ছে!
আসলে, কাশ্মীরের মানুষের আন্দোলনকে মুসলিম ধর্মের আন্দোলন হিসেবে দেখাটাতেই ভুল আছে। বিষয়টি জটিল। এত সরলীকৃত বিশ্লেষণ মূল সমস্যা সন্ধানে আরও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে! গৌতম নওলাখার কাশ্মীর শীর্ষক প্রবন্ধে পড়লাম, তিনি বলছেন, অনেক সময় সমস্যা বড় হয়ে যায় যখন দেখি, আন্দোলনকারীরা আন্দোলনের প্রকৃতি নির্ধারণ করেন না। সেটা ঠিক করে দেন শাসকরাই। নেলসন ম্যান্ডেলা নাকি বিল ক্লিনটনকে এক বার বলেছিলেন, লড়াইয়ের প্রকৃতি নিপীড়িত মানুষেরা ঠিক করে না, ঠিক করে নিপীড়ণকারীরা! কাশ্মীরিদের লড়াই আসলে রাজনৈতিক লড়াই। ১৯২৭-এর আইন অনুসারে তাঁরা স্বায়ত্তশাসন চান। লাদাখ বা জম্মুর মানুষও চান। পাকিস্তান পাকিস্তানের মতো করে তাদের কার্যসিদ্ধি করতে চাইবে। কিন্তু সেটাও পাকিস্তানি রাজশক্তি! আবার ডোগরা হিন্দু রাজার শাসনকাল থেকে মুসলিমদের প্রতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য। আজ, ২০১৮ সালে রামমাধব-অমিত শাহরা যদি সেই ভুল করেন তবে সমস্যার সমাধান দূর অস্ত্!
’৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় কাশ্মীরের দুই রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তির পক্ষেই রায় দেন। কিন্তু তার পরেও দিল্লির সরকার বাহাদুর কাশ্মীরের মানুষের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে মাথা ঘামালেন কোথায়?
আইরিশ জনগণের পরাধীনতা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মুক্তির পথের বাধা।এখানে আইরিশ নিপীড়িত মানুষকে নিজেদের লোক বলে ব্রিটিশ আমজনতা মনে করতে পেরেছিল কি? কাশ্মীরেও জাতিরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষ লড়ছে! আবার ভারতের নানা প্রান্তে আদিবাসী, দলিত, কৃষকদের প্রতিবাদ আন্দোলনও সেই একই রাজশক্তির বিরুদ্ধে!
রাজ্যপাল নতুন! রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এই রাজনীতি কি তিনি মানতে রাজি হবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy