হাতবদল: কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মাতাপুত্র, দিল্লি, ১০ অগস্ট। পিটিআই
সে দিন চোখে প্রায় জল এসে গিয়েছিল সনিয়া গাঁধীর। কতই বা বয়স তখন, তেইশ-চব্বিশ। সবে ইতালি থেকে গাঁধী পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে এসেছেন। এক দিন ইন্দিরা গাঁধী বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে নতুন বৌমা-র জন্য একটা চিঠি ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাতে নানা উপদেশের সঙ্গে বেশ কিছু কড়া কড়া কথাও ছিল।
ইন্দিরার দীর্ঘ সময়ের ব্যক্তিগত সহকারী উষা ভগত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, সনিয়া তাঁর কাছে এসে ভেঙে পড়েছিলেন। বুঝতে পারছিলেন না, শাশুড়ি-মায়ের কিছু অপছন্দ হলে কেন তিনি সেটা মুখে বললেন না? কেন চিঠি লিখতে হল? উষাকে সে দিন বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছিল যে, ইন্দিরা এমনই, সব কিছু মুখ ফুটে বলেন না, নিজের বাবা, এমনকি স্বামীকেও অনেক কিছু চিঠি লিখে জানাতেন। উষা লিখেছেন, এ সবে অভ্যস্ত হয়ে সনিয়া দ্রুত ইন্দিরার আস্থা জিতে নিয়েছিলেন। প্রথম থেকেই বোঝা যেত, সনিয়া গোছানো মানুষ। হম্বিতম্বি করেন না। কিন্তু নিজে কী চান আর কী চান না, ভালই জানেন। সেই মতোই চলেন। উষা ইন্দিরা-সনিয়ার মধ্যে পুত্রবধূকেই ‘স্ট্রঙ্গার’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
পাঁচ দশক কেটে গিয়েছে। এক নম্বর সফদরজং রোডের বাড়ির নতুন পুত্রবধূ এখন বাহাত্তর ছুঁয়েছেন। মেনে নেওয়া কঠিন, তিনি কারও চাপে সিদ্ধান্ত নেন। নিজে না চাইলে অন্য কেউ তাঁকে দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নেবে, ভাবা যায় না। তাই এও মানা যায় না যে, শনিবার রাতে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে নিছক দলের প্রবীণ নেতাদের চাপেই সনিয়া গাঁধী ফের সভানেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। বোধ হয় সনিয়া নিজেই বুঝতে পারছিলেন, তিনি হাল না ধরলে দলটা সত্যিই টুকরো হয়ে যাবে।
প্রশ্ন হল, নতুন করে হাল ধরে সনিয়া কি কংগ্রেসকে নতুন দিশা দেখাতে পারবেন? এক দিকে ক্রমশ নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চতা বাড়িয়ে চলতে মরিয়া নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের জুটি। অন্য দিকে বিজেপি-আরএসএসের নিচু তলা থেকে তৈরি সংগঠন। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সংখ্যার দাপট। প্রতিটি বিরোধী দলের নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডির তদন্ত। এই চক্রব্যূহে সনিয়া কী ভাবে লড়বেন বিজেপির বিরুদ্ধে?
২০১৭-র ডিসেম্বরে ছেলের হাতে সভাপতির দায়িত্ব তুলে দেন যখন, দলের শীর্ষপদে সনিয়ার ১৯ বছর হয়ে গিয়েছে। বিদেশিনি থেকে হয়ে উঠেছেন ভারতীয় রাজনীতিতে অ-বিজেপি দলগুলির প্রধান সূত্রধর। মায়াবতী, মুলায়ম সিংহ যাদব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। বিদেশিনি প্রশ্নে দল ছেড়ে দেওয়া শরদ পওয়ারের সঙ্গেও জোট বাঁধতে পারেন।
আবার এও সত্যি, সনিয়া গাঁধীর জমানাতেই কংগ্রেসের হাত থেকে উত্তরপ্রদেশ, বিহার-সহ উত্তরের হিন্দি বলয়ে কংগ্রেসের শিকড় উপড়ে গিয়েছে। অন্ধ্র ভেঙে তেলঙ্গানা গঠনের জেরে দক্ষিণে পুরনো গড় হারিয়েছে কংগ্রেস। ইউপিএ সরকারের আমলে অন্তরাল থেকে তিনি একের পর এক অধিকারভিত্তিক আইন তৈরিতে ভূমিকা নিয়েছেন। কাজের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকার। তাতে ভর করেই দ্বিতীয় বার ইউপিএ সরকার ক্ষমতা পেয়েছে।
আবার তাঁর আমলেই ‘হিন্দুত্ব’ মাথাচাড়া দিয়েছে। ২০১৪ সালে কংগ্রেস ধরাশায়ী হওয়ার পরে এ কে অ্যান্টনিকে হারের ময়না-তদন্তের ভার দেওয়া হয়। অ্যান্টনি রিপোর্টে বলেন, ‘মুসলিমদের পার্টি’র ভাবমূর্তি তৈরি হওয়ায় কংগ্রেসের ক্ষতি হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ভরসা দেওয়া জরুরি। কিন্তু হিন্দু মননে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, কংগ্রেস সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করে। দলের সংগঠনও দুর্বল হয়েছে। কংগ্রেস কখনওই বিজেপি, সিপিএমের মতো ক্যাডার-ভিত্তিক পার্টি ছিল না। কিন্তু দিনে দিনে কংগ্রেস আরও আরামকেদারায় বসে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত নেতানেত্রীর দল হয়ে উঠেছে।
কংগ্রেসের এই নেতারা এখনও মনে করেন, মোদী-শাহ জুটি শুধুমাত্র টাকা, বিপণন ও মেরুকরণ-জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করে ভোটে জেতেন। কিন্তু তাঁদের পরিশ্রম, দিনের পর দিন রাজ্য সফর, উদয়াস্ত সংগঠনের কাজ করা, নিচুতলা থেকে উপরতলা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের দিয়ে কাজ করানো এবং মতাদর্শ মতো নতুন ভারত তৈরির অদম্য ইচ্ছা— কংগ্রেস নেতারা স্বীকার করতে চান না।
রাহুল গাঁধী কংগ্রেসের এই আরামকেদারায় বসে রাজনীতি করার সংস্কৃতি ভাঙতে একটা ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন। নিচুতলা থেকে নতুন মুখ তুলে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। তিনি এখন দেশ জুড়ে পদযাত্রায় নামার কথা ভাবছেন। তবে সেটা হার থেকে শিক্ষা নিয়ে। চাবুক হাতে সংগঠন চালানোর মতো ‘অমিত শাহ’কে তিনি পাশে পাননি।
সে দিক থেকে সনিয়া গাঁধীকে সভানেত্রীর পদে ফিরিয়ে আনা কংগ্রেস নেতাদের চূড়ান্ত সততার নিদর্শন। একেবারে হলফনামা দিয়ে স্বীকার করে নেওয়া, গাঁধী পরিবার ছাড়া কংগ্রেসে ভরসা করার মতো আর কেউ নেই। সহজ ভাষায়, সরল মনে মেনে নেওয়া, গাঁধী পরিবার নামক আঠা না থাকলে কংগ্রেসের নেতারা এককাট্টা থাকতে পারবেন না। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখা দিলে, সিদ্ধান্ত জট পাকিয়ে গেলে তাঁদের ‘হাইকমান্ড’ গাঁধী পরিবারের দরবারেই চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য হাজির হতে হয়েছে, হবেও।
সরকারি ভাবে অবশ্য ঘোষণা হয়েছে, সনিয়া অন্তর্বর্তী সভানেত্রী। অদূর ভবিষ্যতে অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্র মেনে কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচন হবে। সভাপতি পদে নির্বাচন অবশ্য ২০০০ সালেও হয়েছিল। ১৯৯৮-এর মার্চে সনিয়া কংগ্রেস সভানেত্রী পদে মনোনীত হন। দু’বছর পরে, ২০০০-এর নভেম্বরে সভাপতি পদে নির্বাচনে সনিয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের নেতা জিতেন্দ্র প্রসাদ। তাঁর প্রধান মন্ত্র ছিল, দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ফেরাতে হবে। কিন্তু প্রথমে তাঁকে ভোট দেওয়ার আশ্বাস দিলেও, উত্তরপ্রদেশের নেতারাই একে একে পিছু হটেন। কংগ্রেস সভাপতি পদের ভোটে ৭,৭৭১টি ভোটের মধ্যে জিতেন্দ্র মাত্র ৯৪টি ভোট পেয়েছিলেন। শ’দুয়েক বাতিল ভোট বাদ দিলে বাকি সবটাই সনিয়ার ঝুলিতে গিয়েছিল। জয়ের পর সনিয়া বলেছিলেন, জিতেন্দ্র তাঁর বিরুদ্ধে লড়ে ভুল করেননি। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের জন্য জিতেন্দ্রর কর্মসূচি রূপায়ণেও তাঁর আপত্তি নেই। এ বারও অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সনিয়া বলেছেন, খুব দ্রুত সভাপতি নির্বাচন সেরে ফেলতে হবে। তবে বাস্তবে কী হবে, তা সময়ই বলবে।
অনেক নেতাই মনে করেন, কংগ্রেস যেমন গাঁধী পরিবারকে ছাড়া চলতে পারে না, গাঁধী পরিবারও কংগ্রেসকে অন্য কারও হাতে ছেড়ে ভরসা পায় না!
ইন্দিরার মৃত্যুর পর রাজীব গাঁধীর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন সনিয়া। তার আগে সঞ্জয় গাঁধীর মৃত্যুর পরেও রাজীবের রাজনীতিতে নামাতেও তাঁর আপত্তি ছিল। দু’বারই কংগ্রেসের কথা ভেবে শেষে মত বদলান সনিয়া। ১৯৯১-তে রাজীবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সনিয়া রাজনীতিতে নেমে, স্বামীর শূন্যপদ নিতে রাজি হননি। কিন্তু ছ’বছর পরে যখন কংগ্রেসে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিল, তখন সেই সনিয়াই রাজি হন।
একই আশঙ্কায় সনিয়া গাঁধী ফের হাল ধরেছেন। কোনও ব্যক্তি নয়। পরিস্থিতি তাঁকে বারবার নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করেছে। এখন তিনি দলের পরিস্থিতি বদলাতে পারেন কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy