কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের কি তবে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের উপর যথেষ্ট ভরসা নাই? গোময় ও গোমূত্রে কী কী মৃতসঞ্জীবনীসুধা লুকাইয়া আছে, গত কয়েক বৎসরে গৈরিক নেতারা বহু বার জানাইয়াছেন। গরুর পাচন ও রেচনতন্ত্র যে সোনা, ক্যানসারের মহৌষধি, রক্তচাপ কমাইবার দাওয়াই আদি মহামূল্যবান বস্তুসমূহ উৎপাদনের সর্বোৎকৃষ্ট কারখানা, ভারতবাসী এত দিনে বহু বার শুনিয়াছে। তবে আর ‘প্রকৃত ভারতীয় গরু’-র মল-মূত্র-দুগ্ধ লইয়া গবেষণার প্রস্তাব আহ্বান করিতেছে কেন কেন্দ্রীয় দফতর? গৈরিক নেতৃত্বের মুখের কথায় অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির ছাপ্পা বসাইবার তাগিদে? গরুর ‘প্রকৃত মূল্য’ প্রমাণ করিয়া তাহা ভক্ষণকে দেশদ্রোহিতার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসাবে প্রমাণ করিতে? গৈরিক বাহুবলীদের দাপটে ইতিমধ্যেই গরুর প্রাণ মনুষ্যপ্রাণের তুলনায় মহার্ঘ বলিয়া প্রমাণ হইয়া গিয়াছে। তবে তাহা নিতান্তই রাজনৈতিক প্রমাণ, গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত। এই বার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের গবেষণায় গরুর মাহাত্ম্য প্রমাণের পর তাহা জ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হইবে। অবশ্যই এই জ্ঞানও, বিশুদ্ধ গোমূত্রের ন্যায়, শতকরা একশত ভাগ রাজনৈতিক। ভারতের দুর্ভাগ্য, একদা যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিত, এখন তাহা অতীতের অপবিজ্ঞানকেই ধ্যানজ্ঞান করিয়াছে। সর্বব্যাপী অশিক্ষার গাঙে গা ভাসাইয়াছে। এই স্খলন অতি দুর্ভাগ্যের। নেহরু-যুগ বলিতে যে ভারতকে বুঝায়, সেখানে সামগ্রিক ভাবে শিক্ষাহীন সেই দেশটি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কক্ষপথে ঠাঁই পাইয়াছিল ভবিষ্যতের দিকে তাকাইবার অদম্য আগ্রহের কারণে। নরেন্দ্র মোদীরা নেহরুকে মুছিবার অত্যুৎসাহে সেই অগ্রসরতাকেও মুছিয়া ফেলিলেন। আরও দুর্ভাগ্য, কাল না হউক পরশুর পরের দিন বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হইবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের যে ক্ষতি তাহারা করিতেছে, তাহা পূরণ হইবে না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের এই আহ্বানের বিরুদ্ধে শতাধিক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী প্রতিবাদ করিয়াছেন। দাবি করিয়াছেন, অবিলম্বে এই আহ্বান প্রত্যাহার করিতে হইবে। বিজ্ঞানীদের এ-হেন প্রতিবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। খানিক সাধারণীকরণের ঝুঁকি লইয়াই বলা চলে, পেশাগত ভাবে তাঁহারা রাজনীতি-সক্রিয় নহেন। তাঁহারা আন্দোলন করিতেছেন না, সরকারবিরোধিতার দেশব্যাপী প্রবাহে সরাসরি যুক্ত হইতেছেন না। তাহার বাহির হইতেই জোরের সহিত বলিতেছেন যে এমন গবেষণা-প্রস্তাব আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মুখ পুড়াইবে। কথাটি প্রণিধানযোগ্য। প্রসঙ্গত, বিজ্ঞানীদের আপত্তি গোময়-গোমূত্র সংক্রান্ত গবেষণায় নহে, আপত্তি গবেষণার পন্থায়। দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে ধরিয়া লওয়া হইয়াছে যে গোবর্জ্যে ঐশ্বর্য আছেই— তাহা প্রমাণ করাটুকুই গবেষকদের কাজ। কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা এ-হেন নিশ্চিত পূর্বানুমানের ভিত্তিতে হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যে কোনও আধুনিক গবেষণায় তুলনামূলক বিচারের গুরুত্ব অসীম। আলোচ্য গবেষণাপ্রস্তাবে তাহার অবকাশ নাই— সেই গবেষণা শুধু শুদ্ধ ভারতীয় গরুতেই সীমাবদ্ধ। তৃতীয়ত, বিজ্ঞানীরা জানাইয়াছেন, প্রাচীন কালে গোবর্জ্য ব্যবহারে যে রোগব্যাধি নিরাময়ের কথা কেন্দ্রীয় দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে আছে, তাহা অর্থহীন— কারণ, সেই সময় এই তালিকায় থাকা বহু রোগের অস্তিত্বই আবিষ্কৃত হয় নাই। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা আপত্তি করিতেছেন গবেষণার নামে অপবিজ্ঞানের চর্চায়। আপত্তিটি অতি জরুরি, কারণ এই গৈরিক ভারতে অপবিজ্ঞানই মূলধারার মর্যাদা লাভ করিয়াছে। তবে কিনা, বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদেও ভারতের এই আন্তর্জাতিক লজ্জা
ঘুচিতে চলিয়াছে বলিয়া মনে হয় না। সরকারি স্পর্ধা অদম্য, অপ্রতিহত। হয়তো এত দিনে গবেষণা প্রকল্পের নামটিও স্থির হইয়া গিয়াছে— গোমাতৃবন্দনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy