Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Migrant Workers

লজ্জা

ঘরে ফিরিবার পথে মৃত শ্রমিকের পরিসংখ্যান রাখিবার রেওয়াজ না থাকিবারই কথা।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০০
Share: Save:

লজ্জা বস্তুটি এক বার ঝাড়িয়া ফেলিতে পারিলে মস্ত সুবিধা— কিছুতেই আর লজ্জিত হইবার দায় থাকে না। কেন্দ্রীয় সরকার সম্ভবত লজ্জাহীনতার সেই তুরীয় স্তরটিতে উপনীত হইয়াছে। ফলে, সংসদে যখন প্রশ্ন উঠিল, লকডাউনের পর ঘরে ফিরিবার পথে কত পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণহানি হইয়াছে, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গঙ্গোয়ার চোখের পলকটি না ফেলিয়া জানাইয়া দিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাহা জানে না। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত সর্ববৃহৎ মানবিক সঙ্কট, যাহার সুরাহা করিতে না পারিবার লজ্জায় সরকারের নতমস্তক হইবার কথা, তাহা সম্বন্ধে প্রাথমিক তথ্যটিও মন্ত্রিমহোদয়ের নিকট নাই কেন? তিনি জানাইয়াছেন, এই ধরনের পরিসংখ্যান রাখিবার রেওয়াজ নাই। হাজার মাইল হাঁটিয়া ঘরে ফিরিবার মর্মান্তিক চেষ্টা, অথবা হাঁটিতে হাঁটিতে রেললাইনের উপর ঘুমাইয়া পড়া— এই ঘটনাগুলি, এমনকি ভারতেও, নিতান্ত স্বাভাবিক বা প্রাত্যহিক ছিল না। ফলে, ঘরে ফিরিবার পথে মৃত শ্রমিকের পরিসংখ্যান রাখিবার রেওয়াজ না থাকিবারই কথা। কিন্তু, তাহাদের অবিবেচনায় বিপন্ন মানুষগুলি পথে-বিপথে মারা যাইতেছেন, তাহা দেখিবার পরও কেন্দ্রীয় সরকারের সেই পরিসংখ্যান রাখিবার কথা মনে হইল না? যাহারা উমর খালিদের বিরুদ্ধ এগারো লক্ষ পৃষ্ঠার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারে, এই পরিসংখ্যান সংগ্রহ তাহাদের সাধ্যাতীত ছিল? না কি, মন্ত্রিবর যেমন জানাইয়াছেন যে, পরিসংখ্যান নাই বলিয়া ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও প্রশ্ন নাই, তাহাই মূল কারণ? সরকার দায় ঝাড়িয়া ফেলিতে চাহে?

দায় শুধু ক্ষতিপূরণের নহে। সরকার যদি মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাটি না রাখে, তাহার অর্থ, এই মৃত্যুকে সরকার স্বীকৃতি দিতেছে না। যে মানুষগুলি বিপন্ন হইলেন সরকারের আচমকা সিদ্ধান্তে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে সরকার যাঁহাদের জীবন উথালপাথাল করিয়া দিল, সরকার যদি তাঁহাদের বিপন্নতাকেই স্বীকার না করে, তবে সেই বিপন্নতার নৈতিক দায় লইবারও প্রশ্ন সরকারের নাই। অর্থাৎ, সন্তোষ গঙ্গোয়ার জানাইয়া দিলেন, এই মানুষগুলির মৃত্যু সরকারের চোখে অহেতুক। যাঁহারা না মরিয়া গ্রামে পৌঁছাইতে পারিয়াছেন, তাঁহাদের ক্লেশও অহেতুক। আচমকা নোট বাতিলের ন্যায় হঠাৎ লকডাউনের সিদ্ধান্তও যে প্রবল অন্যায় ছিল, তাহা এখন তর্কাতীত ভাবে প্রমাণিত— কিন্তু, সেই ভুল সিদ্ধান্তের দায় ঝাড়িয়া ফেলিবার এই ঔদ্ধত্য আরও বড় অন্যায়। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী কার্যত জানাইয়া দিলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের তাঁহারা যে অব-নাগরিক জ্ঞান করেন, শুধু তাহাই নহে, সেই অব-নাগরিকের দায়িত্ব গ্রহণেও তাঁহারা আর দায়বদ্ধ নহেন। হিসাব নাই, বলিয়া দিলেই ল্যাঠা চুকিয়া যায়।

অথচ, হিসাব রাখিবার সংস্থান আইনেই ছিল। আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইনটি প্রয়োগে সরকার যদি আগ্রহী হইত, তবে জানা থাকিত, কোন রাজ্য হইতে কত জন শ্রমিক পরিযায়ী, তাঁহারা কোন শহরে কাজ করেন। সেই পরিসংখ্যানটি সামনে থাকিলে কর্তারা হয়তো অন্তত এক বার ভাবিতেন, তাঁহাদের খেয়ালখুশির পরিণাম কতখানি মারাত্মক হইতে পারে। জানিবার উপায় থাকিত, লকডাউনের সিদ্ধান্তটি কাহাকে কতখানি বিপন্ন করিল। ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু টাকা দেওয়া গৌণ প্রশ্ন— এই ব্যবস্থা থাকিলে অন্তত এইটুকু বুঝিবার উপায় থাকিত যে, রাষ্ট্র নিজের আচরণের ফলাফল বোঝে, তাহার জন্য লজ্জিত হইলেও হইতে পারে। যে কোনও নাগরিকের নিকট রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা পৌঁছাইয়া দেওয়ার গোড়ার কথা, তাঁহাদের অস্তিত্ব স্বীকার করা। কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটিল। অতঃপর, এই শ্রমিকদের শোষণ করিতে বেসরকারি উদ্যোগেরও দ্বিধা থাকিবে না বলিয়াই আশঙ্কা হয়। নির্লজ্জতা বড় ছোঁয়াচে।

অন্য বিষয়গুলি:

Migrant Workers Migrant Labourers Lockdown Modi Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy