বৃক্ষনিধন চলছেই। —ফাইল ছবি
জুনেই আমরা ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালন করলাম। ২০১৮ সালে ভারত ছিল এই দিনটির আয়োজক দেশ। গত বারের ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’-এর বিষয় ছিল ‘প্লাস্টিক দূষণ ও তার প্রতিকার’। এ বারের ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’-এর আয়োজক দেশ ছিল চিন। এ বারের বিষয় ‘বায়ু দূষণ’।
বর্তমানের প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে বলতে হয় বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির মোকাবিলায় পৃথিবীকে বায়ু দূষণ মুক্ত করার কথা আমাদের ভাবতেই হবে। বিশ্ব পরিবেশ সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর বায়ু দূষণের ফলে প্রচুর মানুষের অকালে মৃত্যু হচ্ছে। ৯০ শতাংশের বেশি বিশ্ববাসী বর্তমানে দূষণমুক্ত বায়ু থেকে বঞ্চিত। বায়ু দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওজোন স্তরের ক্ষয়ের সমস্যাও। আজ থেকে প্রায় ছ’শো বছর আগে বায়ু দূষণের ভয়াবহতার কথা প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা। লন্ডন শহরে তিনি দূষণের সমস্যা মেটাতে কয়লার ব্যবহারে রাশ টেনেছিলেন। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি যে কতটা আধুনিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন তা দেখা যায় ১৯৫২ সালে ধোঁয়াশার কারণে লন্ডনে কয়েক জনের মৃত্যুর মতো ঘটনায়। শুধু লন্ডনই নয়, বায়ু দূষণের কারণে আরও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ভোপালে।
এ কথা প্রমাণিত যে, এই সব কিছুর দায়ভার মানুষের। বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেনের মতো বিভিন্ন গ্যাসের একটি নির্দিষ্ট চক্র রয়েছে। সেই চক্র অনুসারে পৃথিবীতে অক্সিজেন, নাইট্রোজেনের মতো মৌল স্বাভাবিক নিয়ম মেনে আবর্তিত হয়। ফলে পরিবেশে যে কার্বন ডাই অক্সাইড থাকে তা সব সময়ই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের মধ্যে সীমিত থাকে। কিন্তু মানুষের কাজকর্মের ফলে এই চক্র দিনের পর দিন ব্যাহত হচ্ছে। গাড়ি চলাচল-সহ নানা কারণে যে পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হচ্ছে তাকে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসা প্রাকৃতিক চক্রের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। তারই সঙ্গে বিপদের শঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে লাগাম ছাড়া বৃক্ষনিধন। স্বাধীন ভারতে সবুজকে বাঁচানোর জন্য ১৯৫০ সালে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তার পরেও ভারতে বর্তমান বনাঞ্চলের পরিমাণ ২৪ শতাংশ যা প্রয়োজনীয় পরিমাণের থেকে অন্তত ন’শতাংশ কম।
তবে বায়ু দূষণকে রুখতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ করছে। সবুজায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী কিছু পরিকল্পনা নিয়েছেন। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীও রাজ্যের সব জায়গায় দীর্ঘজীবী বৃক্ষের উদ্যান তৈরির পরিকল্পনা পেশ করেছেন। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আশ্বাস জাতীয় সড়কের দু’ধারে লাগানো হবে লক্ষ লক্ষ গাছ। পরিকল্পনাগুলিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তামাম নাগরিকেরা। অরণ্য সপ্তাহ উদ্যাপন তারই সূত্র ধরে। পশ্চিমবঙ্গের অন্য অঞ্চলের থেকে রাঢ় বাংলায় গাছের ঘাটতি এবং ধ্বংসের হার দুই বেশি। এখানে সবুজের উপস্থিতি ১৭ থেকে ১৯ শতাংশ।
কৃষিপ্রধান পূর্ব বর্ধমানে ১৯ শতাংশ হলেও শিল্প এবং খনি সমৃদ্ধ পশ্চিম বর্ধমানে সবুজের পরিমাণ বেশ সঙ্কটজনক। প্রতি বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্রতর হচ্ছে জলসঙ্কট। কমছে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণও। বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, পূর্ব বর্ধমানে কীটনাশকের ব্যবহার, মুড়িকল এবং চালকল থেকে বায়ু দূষিত হচ্ছে। তার সঙ্গে রয়েছে মোটর চালিত ভ্যান। স্থানীয় ভাষায় একে আমরা ভ্যানো বলেই জানি। পূর্ব বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামে ও মফস্সল এলাকায় যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণের প্রধান ভরসা এই ভ্যানো। কিন্তু এই গাড়িগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাটাতেল ও কেরোসিনে চলে। ফলে প্রতিনিয়ত এগুলি থেকে নির্গত হয়ে চলেছে অধিক পরিমাণে দূষিত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। এরা সরাসরি বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এই দূষিত গ্যাসের সঙ্গে থাকছে ক্যানসার সৃষ্টিকারী বেঞ্জোপাইরিন জাতীয় পদার্থ।
২০০৪ সালের সরকারি এক সমীক্ষা অনুসারে, ১২,৬৯৬টি বড় এবং ৪০ হাজার মাঝারি শিল্প কারখানার একটি বড় অংশ পশ্চিম বর্ধমানে অবস্থিত। তা ছাড়া রানিগঞ্জ-আসানসোলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে কয়লাখনি। ফলত এটি হটজোন-এর তকমাভুক্ত। এখানকার বাতাস মাত্রাতিরিক্ত দূষণ কণায় ভারী।
দুর্গাপুর ছাড়া পশ্চিম বর্ধমানে সবুজের অভাব প্রকট। দরকার আরও সবুজের সম্ভার। মানুষ উদ্যোগ নিতে শুরু করছেন বটে কিন্তু সবুজের নিধনে খামতি নেই। সম্প্রতি আসানসোলের, সালানপুর-সহ বেশ কিছু এলাকায় অনেক গাছ কাটা হয়েছে। যেমন, পূর্ব বর্ধমানে কিছুদিন আগে ধ্বংস করা হয়েছে গুসকরা রোডের পাশে থাকা বেশ কিছু গাছকে। গত বছর জামালপুর ব্লকে দু’হাজার দুশো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বর্ধমান কাটোয়া, বর্ধমান-কালনা, বর্ধমান-আরামবাগ প্রভৃতি রাস্তার ধারে থাকা গাছগুলিও রেহাই পায়নি। অথচ দুই জেলাতেই আমরা সাড়ম্বরে পালন করব অরণ্য সপ্তাহ। তথ্য দেব এ বছর কত সংখ্যক গাছের চারা রোপণ করলাম।
তবে কিছু আশার আলোও আছে। সম্প্রতি বর্ধমান শহরে এক একটি প্রতিষ্ঠানে তৈরি করেছে ভার্টিক্যাল গার্ডেন। পড়়ুয়ারা সচেতনতার মাধ্যমে এই বাগান তৈরি করতে সফল হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের গুসকরা পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই ছিল একটি পূর্ণ বয়স্ক বাদামগাছ। তার তলাতেই খেলত শিশুরা। হঠাৎ বিডিও অফিসের প্রাচীর তৈরির সময় গাছটি কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে বিডিও চিত্তজিৎ বসুর কাছে। গাছকে ঘিরে তারা সারাদিন বসেছিল। শিশুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিডিও সাহেব। সম্মান জানিয়েছিলেন খুদে চিপকো আন্দোলনকারীদের। প্রত্যাহার করা হল নির্দেশ। গাছ কাটা রদ হল।
সময় বলছে, এ বার সচেতন হতেই হবে। ফি-বছর অরণ্য সপ্তাহে আমাদের গাছ কাটা এবং গাছ লাগানোর হিসেবটা কষে নেওয়া দরকার। ফি-বছর অরণ্য সপ্তাহ পালনের সময় আমাদের হিসেব করতে হবে আমরা কত গাছ লাগালাম এবং কত গাছ ধ্বংস করলাম। এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে যে যতটা সবুজ লাগানো হয়েছিল তত সংখ্যক গাছকে কি বাঁচিয়ে রাখা গিয়েছে? এই হিসেবটাই আমাদের একটি সুস্থ ও প্রাণোচ্ছ্বল পৃথিবী উপহার দিতে পারে।
নাদনঘাট রামপুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy