Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

একটি চিঠি

এক দিক দিয়া অবশ্য ইহাই স্বাভাবিক। কোনও ব্যক্তিকে যদি বলা হয়, তুমি তোমার নিরপেক্ষ চরিত্র হারাইয়াছ, সে কোন মুখে তাহা স্বীকার করিবে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০০:২৯
Share: Save:

নির্বাচন কমিশনের অফিসে একশত পঁয়তাল্লিশ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির স্বাক্ষর-সহ একটি চিঠি পৌঁছাইয়াছে। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন আইএএস অফিসার, সেনাবাহিনীর প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি, স্বনামধন্য অধ্যাপক ও গবেষক। চিঠিটি যে হেলাফেলার বস্তু নহে তাহা বুঝাইবার জন্য কাহারা পত্রলেখক তাহা বলিতে হইতেছে। অথচ প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, চিঠিটিকে শেষ অবধি হেলাফেলাই করা হইবে। ঠিক যে ভাবে চিঠিতে নির্দেশিত প্রতিটি সমস্যা আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর দিবার প্রয়োজনবোধ করে নাই, সেই একই ভাবে। চিঠির মূল বক্তব্য, ২০১৯ সালের নির্বাচন স্বাধীন দেশের বাহাত্তর বৎসরের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা কম মুক্ত ও নিরপেক্ষ (‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’) নির্বাচন-অনুষ্ঠান হিসাবে স্মরণীয়। পদ্ধতিগত ভাবে বহু নিয়ম ভাঙা হইয়াছে, বহু বার তাহা কমিশনের গোচরে আনিবার চেষ্টা হইয়াছে, সব চেষ্টা বিফলে গিয়াছে। যে হেতু নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি লইয়াই এত সন্দেহের অবকাশ, নির্বাচনের ফলকেও সংশয়োর্ধ্ব বলিবার অবকাশ নাই। পত্রের মধ্যে একটি অনুচ্ছেদ বলিতেছে যে, নির্বাচন কমিশনের মতো জাতীয় স্তরের উচ্চতম প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়াকর্মকে কেন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বলা যাইতেছে না, তাহা প্রমাণ করিবার দায় বা দায়িত্ব নাগরিকের উপর বর্তাইতে পারে না। নাগরিকের কেবল প্রশ্ন তুলিবার অধিকারটিই থাকে।— কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মুখপাত্র কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সরকারি নিরপেক্ষতার কথা তুলিলে তাহা প্রমাণ করিবার দায়টি নাগরিকের উপর চাপাইয়া নিজেরা ব্যঙ্গহাস্যরব তোলা। গণতন্ত্রের অর্থ কিন্তু তাহা নয়। গণতন্ত্রের অর্থ, সরকার ও তাহার প্রতিষ্ঠানের নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা— নাগরিকের সংশয়ের ঊর্ধ্বে উঠিয়া। অর্থাৎ দায়ভারটি অভিযুক্তের, অভিযোগকারীর নহে। প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এমন প্রশ্ন নাগরিক সমাজ প্রথম বার উঠাইতেছে না। গত দুই বৎসর ধরিয়া বিধানসভা নির্বাচনগুলির সময়েও এই অভিযোগ ইতিউতি উঠিতেছিল। জাতীয় নির্বাচন চলাকালীন, শেষ পর্বের আগে, সরকারি আমলারা একই অনিরপেক্ষতার অভিযোগ উঠাইয়াছিলেন। আবার একই অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের দফতরে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল। এত সত্ত্বেও, এখনও পর্যন্ত কোনও তদন্তের আশ্বাস মিলে নাই।

এক দিক দিয়া অবশ্য ইহাই স্বাভাবিক। কোনও ব্যক্তিকে যদি বলা হয়, তুমি তোমার নিরপেক্ষ চরিত্র হারাইয়াছ, সে কোন মুখে তাহা স্বীকার করিবে। এইখানেই সঙ্কটটি অতিমাত্রায় গভীর। যাহাদের উপর পাহারাদারির ভার, তাহারাই যদি তলে তলে পাহারা উঠাইয়া লওয়ার বন্দোবস্ত করে, বাহিরের লোকের পক্ষে তাহা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়ায়। ভারতীয় গণতন্ত্র এখন এমন এক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছে যাহা হইতে বাহির হইবার পথ জানা নাই। নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের উপর এক বার আস্থা হারাইয়া গেলে তাহা ফেরত আনিবার পথ কী, তাহা কোথাও বলা নাই। ফলে এই পত্রখানির উদ্দেশ্য এক দিক দিয়া অসফল। অন্য এক দিক দিয়া কিন্তু পত্রটি একটি গুরুতর কর্তব্য পালন করিল। নাগরিক সমাজকে মনে করাইয়া দিল যে, সাত দফার নির্বাচনপর্বে ভয়ানক কিছু নিয়মভঙ্গ হইয়াছে, যাহার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হওয়া সম্ভব। শাসক পক্ষের পুনর্বিজয়লাভের উৎসবে নিয়মভঙ্গের বিষয়গুলি যেন ভাসিয়া যাইতে বসিয়াছিল। সেগুলিকে আর এক বার স্মৃতিপথে উস্কাইয়া দিয়া গেল এই চিঠি। অতঃপর এই প্রশ্ন আর কত দূর আগাইয়া লইয়া যাওয়া সম্ভব, তাহা দেশব্যাপী নাগরিক সমাজকেই বিবেচনা করিতে হইবে। প্রাতিষ্ঠানিক সততা, দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার বাঁধ এক বার ভাঙিয়া গেলে তাহা জোড়া দেওয়া সহজ কাজ নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Election commission Election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy