গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতিতে তথ্যের অভাব নেই। আর সেই সংখ্যা দেখে ভবিষ্যৎ অনুমানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিদ্বজ্জনদের একাংশ। এই রোগের ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে, আর সেই কাজের সাফল্য বোঝার জন্য জীববিদ্যা যতটা জানতে হয়, তেমনই ফিরে ফিরে আসে রাশিবিজ্ঞান বা স্ট্যাটিস্টিক্স। ওষুধ কি আগে কখনও আবিষ্কৃত হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। তখন কি কম্পিউটারে গাদা গাদা তথ্য ভরে অল্প সময়ে প্রচুর লেখচিত্র আঁকা যেত? একদমই যেত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুগান্তকারী ওষুধ এসেছে কলিযুগে। অর্থাৎ সেই সময় জীবনবিজ্ঞানে জীবন বেশি ছিল, কারণ তথ্য বিশ্লেষণের সুযোগ ছিল কম। আজকের দিনে যে কোন রকম কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সমীক্ষা আর জিরেফোড়নের মতো সম্ভাবনার অঙ্ক। এমনকি, চিকিৎসাবিজ্ঞান বা জীববিদ্যার গবেষণা পত্রিকাতেও সংখ্যার সারণি, আর তাতে পিঁপড়ের মতো সারি দেওয়া অঙ্করাশি।
অঙ্ক কষলে দোষ নেই মোটেই। কিন্তু সেখানে মূল প্রশ্ন হল, এত হিসেবনিকেশ করে আগে যা জানতাম তার থেকে বেশি কিছু বোঝা গেল কি? মোহনবাগানের সঙ্গে কুমোরটুলির খেলা হলে কী ফলাফল হবে সেটা জানার জন্য যদি আগের পরিসংখ্যান খুঁজতে হয় তাহলে মহা মুশকিল। এমনটা হতেই পারে যে কুমোরটুলি মোহনবাগানের সঙ্গে ব্যতিক্রমী একটি খেলায় জিতে গেল। কিন্তু তা অতীতের পরিসংখ্যান থেকে একেবারেই বোঝা সম্ভব নয়। দস্তাবেজের ধুলো ঘেঁটে কলকাতা লিগে মোহনবাগান বনাম কুমোরটুলি সম্পর্কে আপনি যা জানবেন, সেটা এমনিতেই আমাদের জানা। মোহনবাগানের জেতার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। ঠিক তেমনই এটা এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে শরীরে অন্যান্য গুরুতর অসুখ থাকলে কোভিড-১৯ অত্যন্ত বিপজ্জনক। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রাণহানির আশঙ্কা থাকছে। সেই কারণেই এইটুকু বোঝার জন্য বারংবার পরিসংখ্যানভিত্তিক যুক্তিজাল বোনা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। একই কথা সত্যি বিভিন্ন তথ্যের তুলনামূলক আলোচনায়। নিউ ইয়র্কে কতজন সংক্রমিত আর কতজন মারা গেলেন, তার উপর ভিত্তি করে কলকাতা শহরে কোভিড পরিস্থিতি সামলানোর উপায় বাতলানোর কোনও সুযোগ নেই। তাই ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মতো অবাক দৃষ্টিতে হাজার পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে অতিমারি থেকে মুক্তির পথ কম।
এর মধ্যেই আমরা অনেক জায়গায় পড়েছি যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেকোনও পরীক্ষার ফলাফলেই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই ভুলের সম্ভাবনা যৎসামান্য হতে পারে, কিন্তু তা সাধারণভাবে শূন্য নয়। আর সেখান থেকেই আসে এমন এক অঙ্ক, যা পুরোপুরি বাস্তবের প্রতিফলন। সোজা কথায় বলতে গেলে, কেউ যদি হন কোভিড হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী, এবং তাঁর যদি জ্বর জ্বর লাগে তাহলে কোভিড হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্ট। পরীক্ষা করাতেই হবে। ধরা যাক তার ফলাফল বলল, সংক্রমণ হয়েছে। একেবারে অঙ্ক কষে বোঝা যায় যে সেটা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। যদি পরীক্ষা বলে সংক্রমণ হয়নি, তাহলে কিন্তু সম্ভাবনার অঙ্ক বলছে সেই ফলাফল নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করা যাবে না। অর্থাৎ একেবারে সাধারণ মানুষের ভাবনার যে পথ, অঙ্ক ঠিক সেটাই বলে।
এবার উল্টোটা ভাবুন। আপনি গ্রামে থাকেন, শরীরে বিশেষ কোনও উপসর্গ নেই। কোনও সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আপনি জানতে পারলেন আপনার সংক্রমণ হয়নি। ভাল কথা, এবং খুবই উচ্চ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যদি হঠাৎ করে ফলাফল বলে যে আপনি সংক্রমিত, তাতেই লাফিয়ে ওঠার কিছু নেই। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে এই ফলাফল আপনার ক্ষেত্রে ভুল। অর্থাৎ, পরীক্ষার নির্ণয়ক্ষমতা যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন, সংক্রমণ অধ্যুষিত অঞ্চলে আপনার যদি উপসর্গ দেখা যায় সেক্ষেত্রে চিকিৎসা করাতেই হবে। অন্যদিকে, যেখানে সংক্রমণ অত্যন্ত কম, সেখানে উপসর্গবিহীন অবস্থায় অকারণে পরীক্ষা করানো অর্থহীন, এবং তা সম্পদের অপচয়। এই বিষয়টি বোঝার জন্য সম্ভাবনাতত্ত্বের যেটুকু অঙ্ক কষতে হয় তা আজকাল উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়ারা শিখে ফেলেন। সতেরোশো সালের মাঝামাঝি সময়ে টমাস বেইজ এই বিষয়টি অঙ্কের ভাষায় লেখেন। সেই অঙ্ক একেবারেই শক্ত নয়, বরং রাশিবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়, যা কিনা পরিচিত ‘বেইজের উপপাদ্য’নামে।
আরও পড়ুন: করোনা পরীক্ষার পর মৃত্যু, রিপোর্টের অপেক্ষায় ১৬ ঘণ্টা দোকানেই রইল দেহ
আরও পড়ুন: মেডিক্যালের নন-কোভিড চিকিৎসা অ্যানেক্স হাসপাতালে?
ধরে নিন,কোভিড পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল দেওয়ার সম্ভাবনা নিরানব্বুই শতাংশ। কিন্তু কোনও এক বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফল জানার পর তিনি সত্যি সংক্রমিত কিনা তা নিশ্চিত হওয়া সহজ নয়। সেই অঞ্চলে রোগটির প্রাদুর্ভাব ঠিক কতটা সেটা মাথায় রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি। তার উপরেই নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।
সোজা কথায়, গাদা গাদা যে গবেষণাপত্র ছাপা হয় দুনিয়াজুড়ে, তার বেশিরভাগটাই মামুলি। একথা শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞান নয়, সব বিষয়েই সত্য। আর যেখানে সেখানে রাশিবিজ্ঞানের ব্যবহার এখন পরিচিত রচনাশৈলী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তথ্যের পরিমাণ অপ্রতুল এবং সেটুকুও সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হয় না।
ফলে তথ্যলব্ধ অনুসিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অজানা কোনও দিশা খুঁজে পেতে অক্ষম। তার মানে কি যা বলা হচ্ছে তা ভুল? উত্তর হল, তার কিছুটা ঠিক আর কিছুটা ভুল। অর্থাৎ, এত গবেষণা না করে আপনি যদি সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করে কিছু একটা বলে দেন সেক্ষেত্রে যতটুকু মিলবে, দরকচা গবেষণার ফলটাও একইরকম। এবার আপনি যদি সুযোগ বুঝে শুধু মিলের দিকটা তুলে ধরেন, তখন সাধারণ মানুষের কাছে সে অনুমান সঠিক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
শুরুতে তথ্যের অপ্রতুলতার কথায় আসা যাক। সকলেই জানেন, বিভিন্ন গবেষণায় বোঝার চেষ্টা হচ্ছে যে অন্যান্য রোগে গুরুতর অসুস্থ মানুষ (ইংরেজিতে কো-মরবিড) কোভিড আক্রান্ত হলে কোনও একটি বিশেষ ওষুধ খাওয়ার পরেও তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা আনুমানিক কতটা। ধরা যাক, দু’ধরনের ওষুধ আছে। এবার একশো জনকে দেওয়া হল একটি ওষুধ, অন্য একশো জনকে আর একটি। দেখা গেল, প্রথম ওষুধ খেয়ে নব্বুই জন বাঁচলেন, আর দ্বিতীয় ওষুধ খেয়ে পঁচাশি জন। অর্থাৎ, প্রথম ওষুধ খাওয়ার পরে মৃত্যুর হার দশ শতাংশ এবং দ্বিতীয়ের ক্ষেত্রে পনেরো। শতাংশের হিসেব শুধু ওই একশো যোগ একশো, মোট দুশো, নমুনার জন্যই। তথ্যভিত্তিক এই সিদ্ধান্ত সার্বিক ক্ষেত্রে সঠিক অনুমান নয়। গোটা অঙ্কে ঢুকে পাঠক-পাঠিকাদের অধিক বিব্রত করা অনুচিত। তবে প্রথম এবং দ্বিতীয়টির পার্থক্য আদতে পাঁচ শতাংশ কিনা সে তুলনা ভাল ভাবে বুঝতে গেলে হাজার পাঁচেক রোগীর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। এই পার্থক্য যত কমবে, সেটা বুঝতে গেলে আরও বাড়াতে হবে নমুনার সংখ্যা। বাস্তবে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাওয়া হয় এই বিষয়টি। প্রচুর গবেষণাপত্রে নমুনার সংখ্যা অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও বুক ফুলিয়ে ছাপানো হয় সেসব গল্প। সেই কারণেই প্রতিদিনের চিকিৎসায় ডাক্তারবাবুদের অভিজ্ঞতাই অনেক বড় ভরসা, গবেষণার অলীক সারণি নয়।
তবে রাশিবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব কিছু ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করা হয়। রোগ সারাতে ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক কতটা সুফল দেবে তা বুঝতে গেলে তাড়াহুড়ো করে খুব কাজ হয় না। শুরুতে মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয় না এই সমস্ত যৌগ। বরং প্রথম ধাক্কা সহ্য করে না-মানুষেরা। সেই সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ঠিক হয় মানব শরীরে এইসব ওষুধ ঢুকিয়ে দেওয়া ঠিক হবে কিনা। সেক্ষেত্রে অনেকে আসেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে, নিজেকে নমুনা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সভ্যতার ইতিহাসে এঁদের অবদান সত্যিই মনে রাখার মত। প্রতিষেধক কিন্তু সকলকে দেওয়া হয় না। কিছু মানুষ সমীক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিষেধক পান, আর অন্যদের ক্ষেত্রে সূঁচ ফোটানো হলেও আদতে চালান করা হয় সাধারণ কিছু তরল, ইংরিজিতে যাকে বলে প্ল্যাসেবো। তারপর বিভিন্ন ভাগের ওপর ভাইরাসের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেই অনুযায়ী ঠিক হয় ওষুধের গুণমান কিংবা প্রতিষেধকের কার্যকারিতা। এভাবেই বিভিন্ন নিয়মনীতি মেনে বাজারে আসে সেই যৌগ। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই গোটা গবেষণায় অনেক জায়গা থাকে যেখানে খুব নজরদারির সঙ্গে সময় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কোনও রকমের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল কিন্তু ভীষণ বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা থাকেই। ফলে সেই সমস্ত স্বার্থের কথা ভেবে কোথাও যে কোনও গন্ডগোল হবে না সেটাও বলতে পারা শক্ত। তবে আজকের দিনে কোভিড অতিমারি সংক্রান্ত গবেষণায় পৃথিবীর এতগুলো ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জড়িত যে এক্ষেত্রে তথ্যবিকৃতির সম্ভাবনা কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তবে সব তো আর অক্সফোর্ড কিংবা জন্স হপকিন্স নয়। গোলমেলে জায়গাও আছে। একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ, উত্তর ভারতের এক সাধুবাবা পরিচালিত একটি বেসরকারি সংস্থার ভেষজ করোনামুক্তি। জুন মাসের ২৩ তারিখ নাগাদ এই সাড়া জাগানো ঘোষণা। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নাকি সমীক্ষা করা হয়েছে এই ওষুধের কার্যকারিতা সূচক। সাফল্যের হার ওষুধ খাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই একশো শতাংশ। বেচারি পশ্চিমী দেশগুলো বিরিঞ্চিবাবার এই ওষুধের নাগাল পেল না। ভাগ্যিস তার আগেই বিজেপির বানানো আয়ুষ মন্ত্রক (অর্থাৎ, অ্যালোপ্যাথি নয় এমন ওষুধ সংক্রান্ত) নিজের মান বাঁচাতে বিষয়টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কতজনের উপর হয়েছে এই পরীক্ষা? শোনা যাচ্ছে, শুরুতে বলা হয়েছিল দুশো আশি জন করোনাভাইরাস আক্রান্তের কথা, কিন্তু পরে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই সংখ্যা নাকি আসলে মাত্র একশো। এর মধ্যে পঞ্চাশ জনকে ওষুধ দেওয়া হয়নি, আর পঞ্চাশ জনকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। যাদের ওষুধ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে পাঁচজন আবার গোটা প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই পগার পার। আর বাকি পঁয়তাল্লিশ জনের বাবার চরণের ছোঁয়ায় অসুখ সেরেছে। সেই অঙ্কে নাকি এই ওষুধ একশো শতাংশ সফল।
যদি ধরেও নেওয়া হয় এই তথ্য সত্য, তাতেও প্রমাণ হয় না যে এই ওষুধের সাফল্য একশো শতাংশ। পঁচানব্বুই শতাংশের বেশি সাফল্য প্রমাণ করার জন্য প্রায় পঁচিশ হাজার সংক্রমিত মানুষের উপর এই সমীক্ষা হওয়া উচিত। ভুয়ো সমীক্ষায় চিকিৎসাশাস্ত্রের তো দফারফা, তার সঙ্গে রাশিবিজ্ঞানের নাভিশ্বাস। ২৩ জুন সাংবাদিক সম্মেলন করে এই ঘোষণার পরে পরেই এল২৯ জুন আর পয়লা জুলাই। আশার কথা, রাশিবিজ্ঞানের জনক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ১২৭তম এবং মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ১৩৮তম জন্মজয়ন্তীর আগেই পুলিশের কাছে চারশো বিশ ধারায় (সঙ্গে অন্যান্য ধারাও আছে) অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সেটুকু না হলে প্রফেসর শঙ্কুর মিরাকিউলাস বড়ির থেকেও অব্যর্থ, করোনার বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠা করো-নীল বটিকা আর একটু হলেই নোবেল তালিকায় মনোনয়ন পেয়ে যেত!
অতিমারি পরিস্থিতিতে লড়াইটা তাই দু’দিক থেকে। একদিকে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় বহুজাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ এবং সেখানে পরিসংখ্যানের ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা। বেসরকারি পুঁজি তো আর জনগণের স্বার্থে কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধক নিয়ে রাত জেগে কাজ করবে না। তার চাই মুনাফা। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে এই নিয়ে প্রচুর দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন ওষুধের নাম করে কখনও ইতিবাচক আবার কখনও নেতিবাচক পর্যবেক্ষণের ঘোষণা। চিকিৎসাশাস্ত্র এখানে অসম্পূর্ণ, তবে সরাসরি মিথ্যে নয়। অন্যদিকে, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সনাতন আয়ুর্বেদিক ওষুধের কার্যকারিতাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সম্পূর্ণ কোভিড মুক্তির মিথ্যা আশা। দু’ক্ষেত্রেই রাশিবিজ্ঞানের নাম নিয়ে ছেলেখেলা। কোনও রাষ্ট্র তো আর নিয়ম করতে পারে না যে রাশিবিজ্ঞানকে ভুলভাল পথে ব্যবহার করলে সাত দিনের ফাঁসি হবে! সেই সুযোগ নিয়েই আকাশ ছোঁয় হাজার কিংবা লক্ষ কোটির ব্যবসায় অর্ধসত্য বিজ্ঞাপন।
এ বিষয়ে অবশ্য সরকারেরও কিছুটা দায় থাকে। রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের সনাতন সংস্কৃতিকে বিজ্ঞানের মোড়কে বিক্রি করতে গেলে মিথ্যা বিজ্ঞাপন লাগবেই। অবিজ্ঞানের কারবারিদের অনুসিদ্ধান্তে তাই রাশিবিজ্ঞান বেহুঁশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই সময় ভারতের কোভিড আক্রান্তদের সরকারি পরিসংখ্যান ঘাঁটলে বোঝা যাবে যে কেরল, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল। এটা দেখে যদি প্রচার করা হয় যে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামপন্থার দাওয়াই বহু বছর ধরে মানুষের শরীরে কোভিড-বিরোধী প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়েছে, তাহলে বিজ্ঞান বাঁচবে কি? দেশজুড়ে এখন সবথেকে বেশি প্রয়োজন নাম-ঠিকানা ইত্যাদি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সরিয়ে দিয়ে কোভিড আক্রান্তদের সম্পূর্ণ এবং স্বচ্ছ তথ্য। সে তথ্য গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে দিতে হবে দক্ষ পরিসংখ্যানবিদদের। আর সেখানে ঠিক কী কী বিষয় বিশ্লেষণ করতে হবে তা বলে দেবেন চিকিৎসকেরা। তা না হলে মিছে অঙ্ক কষে লাভ নেই, চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতাই সঙ্কটজনক কোভিড-আক্রান্তদের বাঁচার একমাত্র পথ। সামান্য উপসর্গ নিয়ে অসুস্থরা তো এমনিতেই সুস্থ হবেন। উপসর্গবিহীনরা কিছু জানতেই পারবেন না, শুধু অসুখটা ছড়াবেন। তাই নিয়ে আবার একগাদা লেখচিত্র আঁকা হবে। অদক্ষ গবেষণার বাহন হিসেবে রাশিবিজ্ঞানের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার শুধু এদেশে নয়, সে এক জগৎজোড়া ট্র্যাডিশন। কোভিড অতিমারি বছর ঘুরলে কমবে এই আশা করাই যায়। কিন্তু অগভীর এবং অর্ধসত্য পরিসংখ্যান কালজয়ী। তাকে রুখতে মাঠে নামা দরকার আরও অনেক সৎ এবং দক্ষ রাশিবিজ্ঞানী এবং গণিতজ্ঞের, যাঁরা কোনও একদিন আমজনতাকে বোঝাতে পারবেন অর্ধসত্যের বিপদ। মিথ্যেকে উল্টে নিলেই সত্য পাওয়া যায়, কিন্তু অর্ধসত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোভিড-১৯-এর মতোই উপসর্গবিহীন এবং অনেক বেশি বিপজ্জনক।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy