Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
অস্বাস্থ্য, অস্বস্তি থেকে ত্রাণ
Women

ঋতুমতী নারীকে বিব্রত, বিচ্ছিন্ন করাও কি হিংসা নয়? 

২০১০ সালে আয়লা যে বাঁধ ভাঙতে পারেনি, আমপান তা ভেঙে দিয়ে গেল। সে দিন কি অজানা ছিল, ঋতুকালে পরিচ্ছন্ন না থাকলে  কত রকম যন্ত্রণাময় অসুখে ভোগে মেয়েরা?

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আয়লার সঙ্গে আমপানের তফাত কোথায়? হাওয়ার গতি কিংবা ঢেউয়ের উচ্চতা, ক্ষয়ক্ষতি কিংবা ত্রাণে দুর্নীতি, ও সব নেহাত উনিশ-বিশ। বড় পরিবর্তন ত্রাণের প্যাকেটের ভিতর। এই প্রথম সেখানে চাল-ডালের সঙ্গে স্থান পেল স্যানিটারি ন্যাপকিন। থইথই বিপন্নতায় সক্ষমতার খুঁটি।

বিলিও হল কত স্বচ্ছন্দে, বিনা বিতর্কে। যখন কলকাতা থেকেই প্যাক হয়ে সুন্দরবনে গিয়েছে ত্রাণ, তখন চাল-ডালের প্যাকেজে আগেই ঢুকে গিয়েছে স্যানিটারি প্যাড। যখন প্যাক করা হয়েছে স্থানীয় ভাবে, তখন নাকি কোথাও কোথাও প্রশ্ন উঠেছে, খাবারের সঙ্গে প্যাড যাবে একই থলিতে, না কি আলাদা? অনেক জায়গায় মেয়েদের লাইন করিয়ে বিলি হয়েছে। আবার সুন্দরবনের কিছু দ্বীপে পুরুষরা ত্রাণ নিতে এলে তাঁদের হাতেই দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেননি, ‘‘ও আমি নেব না।’’ সমাজমাধ্যমে কথা হয়েছে, কোথায় কত প্যাকেট লাগবে, কে সস্তায় কিংবা ফ্রি দিচ্ছে। লকডাউনের ত্রাণেও স্থান পেয়েছে স্যানিটারি প্যাড। অস্বাস্থ্য, অস্বস্তি থেকে ত্রাণ।

২০১০ সালে আয়লা যে বাঁধ ভাঙতে পারেনি, আমপান তা ভেঙে দিয়ে গেল। সে দিন কি অজানা ছিল, ঋতুকালে পরিচ্ছন্ন না থাকলে কত রকম যন্ত্রণাময় অসুখে ভোগে মেয়েরা? ২০১০ সালেই এক সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভারতে মাত্র ১২ শতাংশ মেয়ে স্যানিটারি প্যাডের নাগাল পায়। কেন্দ্র ঘোষণা করেছে, বিপিএল মেয়েদের এক টাকা দামে প্যাকেট দেবে। ঋতুমতী মেয়েরা অপবিত্র কিনা, তাই নিয়ে শবরীমালা মন্দিরের মামলা ২০০৮ থেকে ঝুলছে সুপ্রিম কোর্টে। তবু দশ বছর আগে ঋতুকাল ছিল ফিসফিসানির ঘেরাটোপে। ‘‘২০১১ সালে আমরা একটি বই বার করতে চাই প্রথম ঋতুর অভিজ্ঞতা নিয়ে। বেশ কিছু লেখিকা তখন বলেছিলেন, বই বার করার আর বিষয় পেলে না?” বললেন প্রকাশক শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত। ও কথা উচ্চারণেরও অযোগ্য, এই বিশ্বাস থেকে কত মা আজও মেয়েদের বলে উঠতে পারেন না, ঋতু কী, কেন। আতঙ্কিত বালিকার কান্না সামলাতে হয় স্কুলের শিক্ষকদের।

কিন্তু মেয়েরা কবে আর মায়েদের কথা শুনেছে, বিশেষ করে যখন হাতে আসতে শুরু করেছে স্মার্টফোন। দেশের সীমান্ত ডিঙিয়ে মেয়েদের কথা চলতে লাগল: এই যে ঋতুমতীকে হামেশা বিব্রত, বিপন্ন করা, এ-ও কি এক রকম হিংসা নয়? ২০১৫ সালের নারীদিবসে জার্মানির মেয়ে ইলোন কাস্ট্রেশিয়া স্যানিটারি প্যাডে ধর্ষণ-বিরোধী স্লোগান লিখলেন। পুরুষরা পিরিয়ডকে এত যখন ঘৃণা করে, তেমন করেই করুক না নির্যাতনকে!

শোরগোল পড়ল সারা বিশ্বে। সেই মার্চ মাসেই দিল্লিতে জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আর তার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা স্যানিটারি প্যাডে যৌন হয়রানি-বিরোধী বার্তা লিখে আটকে দিল ক্যাম্পাসে। মিডিয়াতে ছবি বেরোতে ঢিঢি পড়ল, কিন্তু এক ধাক্কায় ফিসফিসানির ঘেরাটোপ ভেঙে স্যানিটারি প্যাড এল কথাবার্তার খোলা মাঠে। ঋতুরক্ত থেকে ‘এ মা ছি ছি’ হটাতে তৈরি হতে লাগল সামাজিক বিজ্ঞাপন, তথ্যচিত্র, ভিডিয়ো গেম।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পেল প্যাডম্যান। ‘মাচো’ হিরো অক্ষয়কুমার অভিনয় করলেন অরুণাচলম মুরুগানন্তম-এর চরিত্রে — যে মানুষটি একা বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে স্যানিটারি প্যাড বানিয়েছিলেন, যাতে তা সুলভ হয় দরিদ্র মেয়েদের কাছে। ছবি হিট হল, সারা দেশে অনেকগুলো দরজা খুলে গেল— তার একটা পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে। এক সরকারি অধিকর্তা বললেন, ‘‘বান্দোয়ানের কিছু গ্রামের বহু কিশোরী অসুস্থ হয়ে বাঁকুড়ার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হচ্ছিল। জানা গেল, মেয়েরা গোবর-লেপা কাপড় ব্যবহার করার ফলে সংক্রমণ হয়ে পোকা অবধি হয়ে যাচ্ছে।’’ অরুণাচলমের এক সহযোগীকে আনা হল, প্যাড তৈরির প্রশিক্ষণ পেল স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা। সরকারি খরচে বসল মেশিন। স্কুলে স্কুলে পাঁচ টাকায় বিক্রি হতে লাগল প্যাড। হুটমুড়াতে (পুরুলিয়া ২) দ্বাদশ শ্রেণির কিরণ বারুই এমন জমিয়ে প্রচার করল বন্ধুদের কাছে, যে তার নাম হয়ে গেল ‘প্যাড গার্ল’।

মেয়েদের আন্দোলন, বলিউডি ছবি, আর মিডিয়াতে নিয়মিত শবরীমালা মামলা নিয়ে বিতর্ক— স্যানিটারি ন্যাপকিন এল বাথরুম থেকে ড্রয়িংরুমে। জনমতের চাপে ২০১৮ সালের জুলাইতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ১২ শতাংশ জিএসটি প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্র। সে বছরই সুপ্রিম কোর্ট শবরীমালায় সব মেয়েদের প্রবেশের অধিকার দিল। বহু বছরের লালিত ‘অপবিত্রতা’-র ধারণা খারিজ হয়ে গেল এক নিমেষে।

স্যানিটারি প্যাড তার আগেই ঢুকেছে সরকারি প্রকল্পে। অঙ্গনওয়াড়ি দিদিরা কিছু কিছু বিলি করছেন, স্কুলে বসছে প্যাড ভেন্ডিং মেশিন। সরকারি কাজে যত ধোঁয়া তত আলো হয় না। তবে সরকারি সিলমোহর একটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়। তাকে পোক্ত করেছে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। স্মার্ট, চটপটে, সফল মেয়ের হাতে মা তুলে দিচ্ছেন স্যানিটারি প্যাড, এই ছবি ছাপ ফেলছিল গ্রাম, মফস্সলেও। মিনাখার এক বানভাসি দ্বীপে মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে ফ্রি প্যাকেট হাতে নিয়ে এক কিশোরী জানাল, সে প্রতি মাসে প্যাডই ব্যবহার করে। করে এসেছে বরাবর।

রোগাপাতলা মেয়েটি জানে না যে, রাষ্ট্র, বাণিজ্য, সমাজ আন্দোলন, আদালত, মিডিয়া, এতগুলো শক্তির প্রয়োজন হয়েছে, তার হাতে ত্রাণের সঙ্গে ন্যাপকিন পৌঁছে দিতে। বহু বছর-সঞ্চিত সম্মিলিত শক্তিতে উপেক্ষা আর তাচ্ছিল্যের বাঁধ ভেঙেছে। এমন কত বাধা কখন উতরে যায় নারীমুক্তির সাম্পান, কখন পার হয়ে যায় বহু-কাঙ্ক্ষিত এক একটা মাইলফলক, কেউ খেয়ালও করে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Women Period Menstruation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy