ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
পুরনো লব্জে বললে, পিতামাতার প্রতি ঋণের মতোই, আধুনিক বাঙালির বিদ্যাসাগর মশাইয়ের প্রতি ঋণের হাত থেকে মুক্তি নেই। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সাম্প্রতিক সময় ইস্তক বাঙালি দু’টি গর্বের কথা এই অধোগতির চূড়ান্ত মুহূর্তেও ভুলতে পারেনি: আধুনিক শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে বাঙালির গৌরবময় নেতৃত্বের যশ-কথা। দু’টি ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরী ঋণ অপরিমেয় ও মৌলিক। এই পরিসরে শিক্ষা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া জরুরি, যা থেকে তাঁর এই দ্বিমুখী সংস্কার ভাবনারও খানিকটা হদিস পাব, যা না পেলে জন্মের দু’শো বছর পরেও মানুষটা আমাদের কাছে স্রেফ ‘অধরা’ই (‘এলিউসিভ’) হয়ে থাকবেন।
উনিশ শতকে বাংলায় ইউরোপের মতোই নবজাগরণ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক চলতেই থাকবে। সেই নবজাগরণের প্রধান পথিকৃৎরা কতটা ‘প্রগতিবাদী’ বা ‘কৃষকদরদি’ ছিলেন, তা নিয়ে ঝোড়ো বিপ্লবী সমালোচনাও চলবে। কিন্তু তা থেকে সেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে না যাকে ভিন্ন প্রসঙ্গে ইটালীয় লেখক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক উম্বের্তো একো ‘লেখকের উদ্দেশ্য’ বলেছিলেন। রামমোহন রায় থেকে বিদ্যাসাগর হয়ে উনিশ শতকের সংস্কারকামী প্রধান সব মানুষই (রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ-সহ) কোনও না কোনও ভাবে আঠারো শতকের ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তি তথা আধুনিকতা আন্দোলনের মূল বাণী ‘সর্বজনীন যুক্তিবাদ’ দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত ছিলেন, সেই ‘ঋণ’ অস্বীকারও করেননি, যদিও প্রয়োগের সময় ব্যক্তি ও ক্ষেত্র অনুযায়ী তার ফলাফল ভিন্ন হয়েছিল।
এঁদের সকলেই দেশীয় সমাজপ্রেক্ষিত অনুযায়ী ও নিজস্ব প্রতিভায় পশ্চিমি যুক্তিবাদের মর্মকথাকে গড়েপিটে নিয়েছিলেন।
বাংলা তথা ভারতের যে যুগসন্ধিক্ষণে (১৮২০) বিদ্যাসাগরের জন্ম, তখন শিক্ষাসংস্কার ও বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণের নানা উদ্যোগ শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে না ছিল সমন্বয়, না ছিল শৃঙ্খলা। শিক্ষার লক্ষ্য, পদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম নিয়ে বিতর্কও ছিল প্রচুর। সাত দশক পরে প্রয়াণ কালে (১৮৯১) তিনি তাঁর একক ও কিছু সহযোগীর উদ্যোগে রেখে গেলেন আধুনিক ব্যবহারযোগ্য একটি (উচ্চারণ-অনুযায়ী ও মুদ্রণযোগ্য) বাংলা ভাষা, প্রাথমিক ও নীতিশিক্ষার বহু জনপ্রিয় গ্রন্থ, বাংলা মাধ্যম স্কুলব্যবস্থা ও নারীশিক্ষার পাকা বুনিয়াদ। তাঁর নির্মিত বাংলা ভাষার ভিত্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম অধ্যায়।
১৮২৬-এর মে মাস থেকে যে-চত্বরে সংস্কৃত কলেজের ভবন অবস্থিত, তার একটি অংশ সংরক্ষিত ছিল কোম্পানির শাসনকালে ভারতীয়দের জন্য গড়ে ওঠা প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৮১৭’য় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের স্কুল বিভাগটির জন্য। সংস্কৃত কলেজের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, এইচ এইচ উইলসন কলেজের ‘পণ্ডিত’ ও স্কুলের ‘বাবু’দের পৃথক করার জন্য দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে একটা রেলিং দেন। তার এক দিকে হিন্দু কলেজে তখন চলেছে তরুণ শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর প্রভাবে গড়ে ওঠা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর প্রবল (সমালোচকদের মতে ‘উচ্ছৃঙ্খল’) যুগ।
বিদ্যাসাগর ছাত্রাবস্থাতেই আধুনিক পশ্চিমি শিক্ষার মাহাত্ম্য বুঝেছিলেন, কিন্তু এই শৃঙ্খলাহীনতা সমর্থন করেননি। তবে এটাও বুঝেছিলেন, এই আধুনিকতা যদি দেশীয় তথা বাংলা ভাষায়ও সঞ্চারিত হয়, তখনই তা বিদেশি ভাষায় শিক্ষিত এলিটদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, দেশীয় সমাজের ‘ভিতর’ থেকেই আধুনিক পথে সমাজ পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করবে।
নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে ভারতে লেখাপড়ার দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক ধারা ছিল। প্রথমটি প্রাথমিক, মাতৃভাষায় অক্ষর-পরিচয়, পড়া ও লেখা এবং সাধারণ গণিত (যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ ও নামতা), পরের ধাপে শ্রুতিলিখন, চিঠিপত্র মুসাবিদা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও ব্যবহারিক গণিত (টাকার সুদ, জমির মাপ ইত্যাদি বিষয়ে ‘আর্যা’ মুখস্থ করা)। এই অংশ পাঠশালায় শেষ করে অধিকতর শিক্ষালাভেচ্ছুরা সংস্কৃত শিক্ষা ও ধর্ম-দর্শনশাস্ত্রের চর্চার জন্য টোল বা চতুষ্পাঠীতে ও আরবি-ফারসি শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় প্রবেশ করত। টোল বা চতুষ্পাঠীতে প্রবেশাধিকার ছিল কেবল উচ্চবর্ণের। দেশজ শিক্ষার ‘প্রাথমিক’ ও ‘উচ্চ’— এই দু’টি ধারা ছিল, সমাজ বিভাজনের মতোই, সমান্তরাল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।
দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আধুনিক পরিবর্তন আনার ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের বিলক্ষণ সন্দেহ ছিল। এই সন্দেহ পাকাপাকি ‘বিশ্বাস’-এ পর্যবসিত হল, যখন তিনি পরিদর্শক হিসেবে গ্রাম বাংলায় ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে প্রত্যক্ষ করলেন সাবেক দেশজ শিক্ষাব্যবস্থার দুরপনেয় সীমাবদ্ধতাগুলি। প্রসঙ্গত, ১৮৫৫ সালের ১ মে থেকে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের পাশাপাশি বাংলার দক্ষিণ ভাগের চারটি জেলা— নদিয়া, হুগলি, বর্ধমান ও মেদিনীপুরে বাংলা স্কুলের সহকারী পরিদর্শক (ইনস্পেেক্টর) পদে নিযুক্ত হন। চার জেলার প্রান্তে প্রান্তে ঘুরেছিলেন তিনি। ১৮৫৫’র ২২ অগস্ট থেকে ১৮৫৬’র ১৪ জানুয়ারি অবধি প্রতি জেলায় পাঁচটি করে মোট ২০টি ‘মডেল’/আদর্শ বাংলা স্কুল স্থাপন তাঁর অন্যতম কীর্তি।
এর পর স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের কথা। এ ক্ষেত্রে তিনি তিনটি স্তরে কাজ করেছিলেন। প্রথমত, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের সহকারী হিসেবে কলকাতায় নারী শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা; দ্বিতীয়ত, বেথুনের মৃত্যুর পরেও বেথুন প্রতিষ্ঠিত স্কুলের পরিচালন সমিতির অবৈতনিক সম্পাদক হিসেবে স্কুলটির উন্নতি সাধন; তৃতীয়ত, গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক ভাবে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের উদ্যোগ। প্রসঙ্গত, তাঁর পরামর্শে সেই সময়কার মেয়েদের জনপ্রিয় যান পাল্কির গায়ে লেখা হয়েছিল ‘মহানির্বাণতন্ত্র’-র একটি শ্লোকের অংশ: ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষাণীয়াতিযত্নতঃ’। এতে বোঝা যায়, কী ভাবে তিনি শাস্ত্রীয় প্রথাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিকতার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। এবং, চলমান যানের গায়ে লেখা বিজ্ঞাপন যে বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, আধুনিক বিজ্ঞাপন জগতের এই ভাবনাও সেই সময়েই তাঁর মনে উদিত হয়েছিল!
মাতৃ/বাংলা ভাষায় শিক্ষার আর একটি প্রাক্-শর্ত হল ভাল পাঠ্যপুস্তকের সুলভতা। বিদ্যাসাগরের সময় তার যথেষ্ট অভাব ছিল। রেনেসাঁসের গোড়ার দিকে ইউরোপেও আঞ্চলিক ভাষায় যথেষ্ট জ্ঞানচর্চার বইপত্র না থাকায়, প্রথম দিকে লাতিন থেকে অনুবাদ করতে হয়েছে। বিদ্যাসাগরকেও দেখি একাধারে দু’টি ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। এক দিকে, বাংলায় ব্যাকরণসিদ্ধ মুদ্রণযোগ্য অক্ষর ও বানান সংস্কার করে, নানা পাঠ্যপুস্তক রচনা, ছাপা ও বিপণনের আয়োজন। কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে আজ যে বাংলা পাঠ্য ও সাহিত্যিক বইয়ের বিপুলায়তন ব্যবসা, তারও যথার্থ পথিকৃৎ তিনিই।
পাঠ্যপুস্তক রচনার পাশাপাশি ছাপা বইয়ের সম্পাদনা ও সম্মার্জনার প্রতি তাঁর অখণ্ড মনোযোগ চিরদিন বজায় ছিল। তখন কর্মাটাঁড়ের হতদরিদ্র সাঁওতালদের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন তিনি, সেই সময় (১৮৭৮) চর্যাপদের আবিষ্কর্তা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও তাঁর এক সঙ্গী লখনউ যাওয়ার পথে এক রাত বিদ্যাসাগরের আতিথ্যগ্রহণ করেন। রাতে বিশ্রামের পর সকালে উঠে শাস্ত্রীমশাই দেখলেন: “... বিদ্যাসাগর মহাশয় বারাণ্ডায় পাইচারি করিতেছেন এবং মাঝে মাঝে টেবিলে বসিয়া কথামালা কি বোধোদয়ের প্রুফ দেখিতেছেন। প্রুফে বিস্তর কাটকুট করিতেছেন। যেভাবে প্রুফগুলি পড়িয়া আছে, বোধ হইল, তিনি রাত্রেও প্রুফ দেখিয়াছেন। আমি বলিলাম— কথামালার প্রুফ আপনি দেখেন কেন, আর রাত জেগেই বা দেখেন কেন? তিনি বলিলেন— ভাষাটা এমনি জিনিষ, কিছুতেই মন
স্পষ্ট হয় না; যেন আর একটা শব্দ পাইলে ভাল হইত;— তাই সর্ব্বদা কাটকুট করি। ভাবিলাম— বাপ রে, এই বুড়া বয়সেও ইঁহার বাংলার ইডিয়মের ওপর এত নজর।”
এই অনন্য মানুষটির জন্মের দু’শতাব্দী পর তাঁর প্রতি নতমস্তক হওয়া ছাড়া আমাদের আর কী-ই বা করার থাকে!
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy