অসহায় পরিচারিকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
আমরা সভ্যতার অহংকার করি। কিন্তু সভ্যতার নমুনা কি এই রকম! অসুস্থ, অক্ষম, অসহায় এক প্রবীণাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে যে নিষ্ঠুর প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ উঠল মধ্য কলকাতার একটা পরিবারের বিরুদ্ধে, সে প্রতারণার কথা জানলে নিশ্চল হয়ে যেতে হয়, মন অবসন্ন হয়ে আসে।
প্রবীণা পরিচারিকাকে দিয়ে আর কাজ হচ্ছিল না, কারণ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এমত পরিস্থিতিতে গৃহকর্তার কর্তব্য কী? কর্তব্য অবশ্যই পরিচারিকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসার খরচ এবং ঝক্কি বহন করার মতো উদারতা বা ইচ্ছা না থাকলে নিদেনপক্ষে পরিবার-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত ছিল অসুস্থ প্রবীণাকে। কিন্তু গৃহস্বামী কী করলেন? অসুস্থ পরিচারিকাকে তিনি একটা সরকারি হাসপাতাল চত্বরে কোনও মতে ঢুকিয়ে দিয়ে সরে পড়লেন। সরে পড়ার সময় পরিচারিকার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে এলেন, যে কাগজে গৃহস্বামীর নাম-ধাম লেখা রয়েছে বলে গৃহস্বামী পরিচারিকাকে জানিয়ে এলেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাগজটায় লেখা ঠিকানা বা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন, সবই ভুয়ো।
সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষাগুলোর অন্যতম তো মানবিকতার শিক্ষা। মানুষ যত সভ্য হয়েছে, তত বেশি মানবিক হয়েছে। সে রকমই অন্তত জেনে এসেছি এত দিন। তাই আপাতদৃষ্টিতে সভ্য-সুসংস্কৃত হিসেবে ধরা দেওয়া মুখগুলো এমন ভয়ঙ্কর অমানবিক আচরণ করলে জোরদার ধাক্কা খেতে হয়। সভ্যতার শিক্ষা কি তা হলে সর্বত্রগামী হয়নি? সবাই কি সভ্য হয়ে উঠিনি? দেখতে যাঁদের সভ্য মানুষের মতো লাগে, তাঁরা সকলে কি সভ্য নন? অনেকের ক্ষেত্রেই কি সভ্যতা আসলে মুখোশ? এই সব প্রশ্ন মাথা তুলতে শুরু করে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিদারুণ ‘মানবিকতার’ পরিচয় দিয়েছেন। নিজের চেষ্টায় কোনওক্রমে হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছিলেন অসুস্থ প্রবীণা। কিন্তু যখনই জানা গিয়েছে যে, তাঁর হাতে থাকা কাগজে লেখা নাম-ঠিকানা আসলে অস্তিত্বহীন, তখনই হাসপাতালের আচরণ বদলে গিয়েছে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা চিকিৎসা না করেই হাসপাতালের শয্যা থেকে প্রবীণাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: অসুস্থ বৃদ্ধা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে খুঁজছেন আত্মীয়ের হাত
আমাদের তথাকথিত সভ্যতার উচ্ছিষ্ট হিসেবেই দিন দুয়েক কাটাতে হয়েছে প্রবীণা নাগরিককে। পুলিশি হস্তক্ষেপে ফের তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসার ব্যবস্থাও হচ্ছে। কিন্তু কেন চিকিৎসা না করেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল, কারও আত্মীয়-পরিজনের খোঁজ পাওয়া না গেলে কেন তাঁর চিকিৎসা হবে না, যারপরনাই অসুস্থ একজনকে সুস্থ করে তোলার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর পরিবারকে খুঁজে বার করা কী ভাবে হয়ে উঠতে পারে চিকিৎসকদের কাছে— এমন অনেক প্রশ্নের কোনও জবাব নেই।
আমাদের সবার একবার ভেবে দেখা উচিত, সভ্যতা নিয়ে অহংকার করব, নাকি সঙ্কুচিত হব? আমরা সভ্য— এ কথা নিঃসঙ্কোচে এবং সদর্পে উচ্চারণ করতে হলে সভ্যতার কিছু শপথের কথাও তো মনে রাখতে হবে। সভ্যতার অঙ্গীকারগুলোর প্রতি তো নিষ্ঠাবান থাকতে হবে। কী ভাবে শপথগুলোকে রক্ষা করব, কী ভাবে অঙ্গীকারগুলোর প্রতি সৎ থাকব, তা কিন্তু কেউ বুঝিয়ে দেবেন না। পরিণত বয়সের যে কোনও মানুষেরই সে সব বোঝা উচিত। যাঁরা বুঝি না, তাঁরা নিজেদের সভ্য হিসেবে দাবি করতে পারব না। তাঁরা বর্বরের পঙ্ক্তিতেই পড়ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy