এখানেই চার অভিযুক্তকে এনকাউন্টার করা হয়।
চোখের বদলে চোখ, মারের জবাবে মার, খুনের শাস্তি খুন— প্রতিহিংসার সরল হিসাব এ দেশে বরাবরই বহুজনপ্রিয়। তথাকথিত সভ্যতার তথাকথিত অগ্রগতিতে এই প্রতিশোধের আকর্ষণে কিছুমাত্র টোল পড়ে নাই, বরং তাহার জনপ্রিয়তার ধারায় ইদানীং ভরা কোটাল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৃশংস অপরাধের ঘটনাবলি লাগাতার ঘটিতেছে এবং ক্রমাগত গর্জন উঠিতেছে: অপরাধীদের অবিলম্বে শেষ করিয়া দাও। কিন্তু হায়দরাবাদে বীভৎস ধর্ষণ ও হত্যায় অভিযুক্ত চার জন কয়েদি শুক্রবার ভোরে ‘পুলিশের সহিত সংঘর্ষে’ নিহত হইবার পরে সেই অভিজ্ঞতায় নূতন মাত্রা যুক্ত হইল। সংঘর্ষ-মৃত্যুর ঘটনা এ দেশে নূতন নহে। সত্তরের দশকের পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানা হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন রাজ্যে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। তবে সচরাচর রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসবাদী অপরাধে অভিযুক্তরাই ‘পুলিশের হেফাজত হইতে পলাইতে গিয়া’ অথবা ‘নিরাপত্তা রক্ষীদের আক্রমণ করিয়া’ নিহত হইয়া থাকে। ধর্ষণে অভিযুক্তদের ‘এনকাউন্টার’-এ মৃত্যু তুলনায় অভিনব।
কিন্তু তাহা নূতন মাত্রাটির উপলক্ষ মাত্র। এই উপলক্ষে সমাজ ও রাজনীতির দুনিয়া হইতে যে প্রতিক্রিয়া উঠিয়া আসিয়াছে, তাহা কেবল নূতন নহে, গভীর উদ্বেগের কারণ। বস্তুত বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হইবার আগেই অভিযুক্তরা পুলিশের গুলিতে নিহত— এমন সংবাদে দেশ জুড়িয়া যে হর্ষধ্বনি উঠিয়াছে তাহার মূল বাণী: যাহা হইয়াছে, বেশ হইয়াছে। এই জয়ধ্বনিদাতারা কিন্তু বলেন নাই যে, অভিযুক্তদের সহিত সত্যই পুলিশের ‘সংঘর্ষ’ ঘটিয়াছিল, এমন কথা তাঁহারা বিশ্বাস করেন। সুতরাং, অনুমান করা চলে, পুলিশ ওই চার জনকে মারিয়া দিয়াছে, ইহা ধরিয়া লইয়াই তাঁহারা বলিতেছেন: পুলিশ ঠিক করিয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক, বিবেচক, শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বহুলপরিচিত নাগরিকরা এই ভয়ঙ্কর মতটিকে সমর্থন করিতেছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশ প্রকারান্তরে অথবা সরাসরি বলিতেছেন: এমন অপরাধীদের ইহাই উচিত শাস্তি। সমস্বর একাধিক মন্ত্রীর কণ্ঠেও। অর্থাৎ, কেবল নাগরিক সমাজ নহে, আইন প্রণয়ন এবং আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাঁহাদের হাতে, তাঁহাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশও প্রকৃতপক্ষে আইন-আদালতের মূল্য অস্বীকার করিতেছেন!
স্পষ্টতই, আইন-আদালতের ‘যথাযথ’ চিকিৎসা-পদ্ধতি দিয়া অপরাধের মোকাবিলা হয় না বলিয়াই আসুরিক অপচিকিৎসার প্রতি বিভিন্ন স্তরের মানুষের এমন ভয়াবহ আকর্ষণ। এক দিকে পুলিশ প্রশাসনের অপদার্থতা, ঔদাসীন্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, অন্য দিকে অতিবিলম্বিত বিচার-প্রক্রিয়া, দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষ স্বাভাবিক সুবিচারে আস্থা হারাইয়াছে। সেই কারণেই এক দিকে গণপ্রহারে অপরাধী দমনের সামাজিক স্বীকৃতি বাড়িতেছে, অন্য দিকে চলচ্চিত্রসুলভ ‘এনকাউন্টার’-এ পুলিশের গুলিতে অভিযুক্তের মৃত্যুতে সমাজ হাততালি দিতেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারতে হিংস্রতার যে বিস্ফোরণ, বিশেষত প্রতাপশালী কিছু রাজনৈতিক নেতার কথায় অহরহ আইনকানুনের পরোয়া না করিয়া ‘শত্রুনিধন’-এর যে জয়গান এবং তাঁহাদের আচরণে অসহিষ্ণুতার যে অগণন অ-পূর্ব নিদর্শন, এই ‘বেশ হইয়াছে’ কলরবের পিছনে তাহার অবদানও সম্ভবত অনেকখানি। শুভবুদ্ধি এখনও সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয় নাই। এই প্রচণ্ড কলরবের মধ্যেও সুবিবেচনার সুস্থ কণ্ঠস্বর শোনা যাইতেছে বিভিন্ন মহল হইতেই, প্রতিশোধ যে সুবিচারের প্রকরণ হইতে পারে না— সেই গোড়ার কথাটি মনে করাইয়া দিয়াছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। এইটুকুই ভরসা। আর, ভরসা যদি বিফলে যায়? অন্যায়ের জবাবে অন্যায়ই চাই— ইহাই যদি নূতন ভারতের গণ-তন্ত্র হইয়া উঠে? তবে বুঝিতে হইবে, ভারতীয় গণতন্ত্রের শেষ ঘণ্টা বাজিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy