সম্প্রতি তিন তালাক নিষিদ্ধ করে আইন করেছে ভারতের সংসদ।
বাইশে অগস্ট ২০১৭ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক প্রথাকে অবৈধ, অসাংবিধানিক ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুরে শেফালি খাতুনকে তার স্বামী তিন তালাক দিয়েছেন ২০১৯-এর মে মাসে। স্রেফ ‘তালাক’ উচ্চারণে শেষ হয়ে গিয়েছে বাইশ বছরের বিবাহিত জীবন। তিন স্কুলপড়ুয়া সন্তান নিয়ে শেফালি নিরাশ্রয়।
শেফালি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা জানত। তাই থানায় গিয়েছিল। থানা জানিয়েছে, মুসলিম মেয়েদের তালাকের পর ঘরে ফেরানোর প্রশাসনিক নির্দেশ থানায় আসেনি। গ্রামের মোড়ল-মাতব্বর নিদান দিলেন, অন্য পুরুষকে বিয়ে করে, সে তালাক দিলে তবেই পূর্বের স্বামীকে ফের নিকা করতে পারবে শেফালি। এই প্রথার নাম নিকা হালালা।
সম্প্রতি তিন তালাক নিষিদ্ধ করে আইন করেছে ভারতের সংসদ। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অগ্রাহ্য করে প্রচলিত ধারাকে অব্যাহত রাখছে গ্রামের যে সব মাতব্বর, তারা কি আইনকে মান্যতা দেবে? তিন তালাক এবং নিকা হালালা বন্ধ হয়নি। ইসলামপুরের দুঃস্থ, পিতৃমাতৃহীন মেয়ে জহুরা তালাক পেয়ে পথে পথে ঘুরল ক’দিন। পরে মোড়লদের নির্দেশে নিরুপায় হয়ে দূর সম্পর্কের জামাইবাবুর সঙ্গে বিয়ে, তাঁর সঙ্গে ‘সহবাস’ নামক ধর্ষণের পর এক রাশ লজ্জা নিয়ে স্বামীর ঘরে ফিরতে পেরেছে। এরই নাম বুঝি ধর্ম?
নিকা হালালা বিধি যদি রচনা হয়েই থাকে, তা হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় নিয়মনীতির ইতিমধ্যে বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। এ দেশেও হয়েছে। ইসলামে সুদ অবৈধ। কোরানে তো সুদ নেওয়া হারাম। অথচ ব্যাঙ্কে জমানো টাকার সুদে ভারতে বহু মুসলমানের সংসার চলে। ইসলামে মদ নিষিদ্ধ। অথচ মদ খেয়ে মেয়েদের উপর অত্যাচার, এমনকি মদ্যপ অবস্থায় তালাক দেওয়া, প্রচুর ঘটছে। শরিয়ত রক্ষায় ল বোর্ড ও ধর্মীয় রক্ষকদের এখানে কোনও ভূমিকা নেই? পণপ্রথা ইসলামে নিষিদ্ধ, অথচ মুসলিম কন্যার পিতামাতা পণ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেবল মেয়েরা মানুষের মতো বাঁচার অধিকার চাইতে গেলেই শরিয়ত রক্ষার অজুহাতে অমানবিক নির্দেশের চাবুক চালনা হবে? ২০০৫ সালে উত্তরপ্রদেশে ইমরানা শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার পর পঞ্চায়েত ও দেওবন্দ ফতোয়া দেয়, ইমরানাকে শ্বশুরের সঙ্গে থাকতে হবে। নীতিহীন, অমানবিক এই রায়কে ল বোর্ড সমর্থন করেছিল। ইসলামে এমন আইন কোথায় আছে? এটা কি শরিয়তি নিয়ম?
ইসলাম ধর্মই তো প্রথম বিবাহে মত প্রকাশের অধিকার দেয় মেয়েদের। বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, বিধবা বিবাহের অধিকার, শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার অধিকার দেয় এই ধর্ম। হজরত মহম্মদের নির্দেশে জানা যায়, শরিয়তের দ্বারা সমস্যার সমাধান না হলে মনুষ্যত্বকে কাজে লাগাবে। আজকের দিনে ‘হিল্লা বিয়ে’ (তালাক হওয়া নারী স্বামীর ঘরে ফিরতে হলে অন্য পুরুষকে বিবাহ) কার্যত ধর্ষণের অনুমোদন। এটা কি মানবিক, না রুচিসম্মত? মেয়েদের আত্মমর্যাদার প্রতিবন্ধক এই আইন। এর পরিবর্তনের সময় এসেছে। নীতিহীন নিকা হালালা নিষিদ্ধ করার দায় নিতে হবে আমাদের দেশের সরকারকেই।
বিজেপি সরকার দাবি করছে, মুসলিম নারীদের আত্মসম্মান, সামাজিক নিরাপত্তা মর্যাদা দিতে তিন তালাক বন্ধ করেছে তারা। কিন্তু তালাক আইনে রয়েছে স্ববিরোধিতা ও প্রতারণার কৌশল। তালাক দিলে স্বামী জেল খাটবে তিন বছর। জেলে থাকলে স্ত্রী খোরপোশ আদায় করবে কী করে, তার উল্লেখ নেই। ধরা যাক, অন্যায় ভাবে তালাক দিয়ে, শাস্তি পাওয়ার পর অনুতপ্ত পুরুষটি স্ত্রীর কাছে ফিরতে চাইল। তখন যদি শরিয়ত দেখিয়ে দাবি করা হয়, স্ত্রীকে আগে নিকা হালালা করতে হবে? তা তো নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়নি? পূর্বের স্ত্রীকে দেওয়া তালাক অবৈধ হলেও, পুরুষটি যদি আর একটি মেয়েকে বিবাহ করে? বহুবিবাহও তো নিষিদ্ধ হয়নি।
বিজেপি দাবি তুলেছে, তারাই মুসলিম মেয়েদের রক্ষাকর্তা। অথচ কাশ্মীরের কাঠুয়াতে আট বছরের কচি মেয়ে আসিফার ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে তাদেরকেই মিছিল করতে দেখা গিয়েছে। গোরক্ষার নামে দলিত-মুসলিমদের খুন, মুসলিমদের মাঝে মাঝেই বাংলাদেশ-পাকিস্তানে পাঠানোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। হিন্দুশাস্ত্রের ধ্বজাধারী কিছু হিন্দুত্ববাদী নেতা ‘সতী’ হওয়ার মারাত্মক প্রথার পক্ষে সওয়াল করেছেন। সতীদাহ বন্ধ করার ‘অপরাধ’-এ রামমোহন রায়কে ‘ব্রিটিশের দালাল’ বলেছেন। তাঁরাই যখন মুসলিম নারীর অধিকার রক্ষার আওয়াজ তোলেন, তা নিয়ে সন্দেহ জাগতে বাধ্য। দেখা গেল, তিন তালাক নিষিদ্ধ করার আইনটি মুসলিম পুরুষকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করতে বেশি আগ্রহী, মেয়েদের নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে সুরক্ষিত করতে নয়। এটা কি ভারতের মুসলিম মেয়েদের সঙ্গে প্রতারণা নয়?
মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে হলে তালাক, বহুবিবাহ, নিকা হালালা, পৈতৃক সম্পত্তিতে সমানাধিকার, দত্তকের অধিকার, এ সব প্রশ্নে চাই আইনের সুরক্ষা। মুসলিম মেয়েরা ভারতেরই নাগরিক। তাদের প্রকৃত নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার ও আইনি সুরক্ষা না দিয়ে বিজেপি সরকার নিজেকে ‘রক্ষাকর্তা’ বলে দাবি করতে পারে না।
লেখক: সম্পাদক, রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy