Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
উত্তর সম্পাদকীয়
Nirbhaya Rape Case

তা হলে, এই কি ন্যায়ের শান্তি!

তা হলে কোল খালি মায়ের বুকে মাথা গুঁজে অন্য এক কোল খালি মা কাঁদছেন— এমনটাই অপেক্ষা করছে ১ ফেব্রুয়ারি? এর উল্টো কোনও ছবি আমরা কল্পনা করতে পারি না তা হলে? লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম

জিনাত রেহেনা ইসলাম
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৫১
Share: Save:

অবশেষে সাত বছর পেরিয়ে ফাঁসি হচ্ছে চার ধর্ষকের। দেশজুড়ে উদযাপন। বিবেক জুড়ানো শান্তি। অন্যায়কারী এ ভাবেই পর্যুদস্ত হোক। মনের দাবি তো এমনই। ন্যায় পাওয়ার উল্লাসে তাই শামিল মেয়ের পরিবার। ব্যতিক্রমী অপরাধীর যোগ্যতম শাস্তি তাকে প্রাণে মেরে ফেলা। এই বিশ্বাসে তো কায়েম সমাজ ভাবনা। সেই ভাবনার জয় তবে সুনিশ্চিত হচ্ছে। বিচার বিলম্বিত নয় প্রত্যাখ্যাত। মানুষের মনে বিচারব্যবস্থা নিয়ে এই ছবি বহুযুগের। চার ধর্ষকের ঐতিহাসিক ফাঁসি ক্ষণিকের বিরাম চিহ্ন কি এনে দেবে এই অবিচারের ধারাবাহিকতায়? নির্ভয়াদের ললাট লিখন তবে কি শীঘ্রই বদল হতে চলেছে? মহানগরীর রাতে এক বুক বিশ্বাস নিয়ে কিশোরীদের দামাল মেয়ে হয়ে ওঠার মুহূর্ত তবে কি হাতের মুঠোয়? সত্যিই মেয়েদের ন্যায়ের জয় কি প্রতিষ্ঠা হল?

নির্ভয়ার ঘটনা আসলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সভ্যতার সেই বারান্দা যেখানে চিন্তার কূপমন্ডুকতার জয়জয়াকার। রাজনৈতিক নেতা থেকে ধর্মগুরু সবার মুখে দোষারোপের ভাষা। নির্ভয়ার কর্তব্য ও আচরনবিধি নিয়ে হাজারও সওয়াল। আদালতের বাইরে বিচারের সামাজিক আসর। একাধিক পরামর্শ। কাঠগড়ায় মেয়ের চরিত্র, পোশাক। সঙ্গে পুরুষ বন্ধু রাখার অন্যায়! রাতের বেলায় বাইরে বেরোনোর স্পর্ধা। সর্বশেষ ধর্ষককে ভাই বলে অনুরোধ জানিয়ে তাকে ধর্ষণ থেকে বিরত না করতে পারার আশ্চর্য দায়। অন্ধ পুরুষহিতৈষী থেকে গোষ্ঠীশাসনে বিশ্বস্ত মানুষের কলরব ভুক্তভোগীর প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ ঠিকই। কিন্তু কোথাও সমানুভূতি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে যেন নির্ভয়া। রাজপথে ঘণ্টা ধরে পড়ে থাকা বিবস্ত্র মেয়েটির হাত নেড়ে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি ও লড়াই স্মৃতি থেকে মুছে না কিছুতেই। সাহসীকতা ভরা এক নামের উপহারে তার ব্যক্তিত্ব সেজেছে। কিন্তু তাতে বদল হয়নি আশপাশের চিত্র। সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে প্রকাশ্যে পালিয়ে গেছে একদল মানুষ।

নির্ঝঞ্জাট জীবনে অযথা হয়রানির কথা ভেবে অন্য একদল এড়িয়ে গেছে পথে পড়ে থাকা মেয়েটিকে। তবে মানুষের গড়া সাধের সমাজে ভয় কাকে? ভরসা কাকে? নির্ভয়ার সঙ্গী বন্ধুটির অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন চ্যানেলে গিয়ে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণসহ সাক্ষাৎকার দিয়েছে। নির্ভয়ার জন্য লড়াই এর সবচেয়ে বড় লড়াকু যাকে মানা হয়েছিল তার এই কাপুরুষোচিত আচরণ বেদনাদায়ক। ভালোবাসা ও বিশ্বাস সবটাই নিমেষে মিথ হয়ে যায়।

ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দুই মহিলা মুখোমুখি। সাজাপ্রাপ্ত ছেলের মা আঁচল পেতে ভুক্তভোগীর মায়ের সামনে। ছেলের অপরাধের জন্য শেষবার ক্ষমা প্রার্থণা করছে। সন্তান একজন হারিয়েছেন। অন্য জনের অপেক্ষা সময়ের। দুই মা এর বুক খালি হয়ে যাওয়ার যন্ত্রনাও এক। এই দৃশ্য কি বদল হতে পারত? এঁরা কি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দুঃখ ভাগ করে নিতে পারতেন? হয়ত সেই দিন অপরাধের খাতাটাও বন্ধ হয়ে যেত। এই সমাজ আমাদের। আমরাই একে ভালো বা খারাপ করার ক্ষমতা রাখি। আমাদের শাসন করতেই বিপুল আয়োজন। আমরাই অন্যায় করি। আমরাই বিচার চাই। আমরাই ফাঁসি দেওয়ার দাবী তুলি সহনাগরিকদের। তারপরেও কি অপরাধের ইতিহাস বদলায়? ধর্ষণে ভুক্তভোগীর সুবিচার ও ক্ষতিপূরণ বলে সত্যিই কি কিছু হয়? আমরা চাঁদে যাই। পাহাড়ের মাথায় উঠি। বড় বড় যুদ্ধবিমান কিনি। প্রযুক্তিকে শাসন করি। শুধু এক ধর্ষণমুক্ত সমাজ দিতে পারিনা মেয়েদের। এই অনন্ত না পারাটাকেই স্বাভাবিক ও সত্য বলে বিশ্বাস করাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে শেখানো হয়। তাই দেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হোক বা নির্বাচনী প্রচার হোক, কোথাও জিরো ধর্ষণের বিষয়ে একটিও কথা না থাকলে বিস্মিত হই না আমরা। মেয়েদের নিরাপত্তার সঙ্গে দেশের রাজনীতির যোগ থাকলেও অর্থনীতি বা সমৃদ্ধির সম্পর্ক নির্নয়ের কথা একবারও ভাবতে শেখানো হয় না মেয়েদের।

নির্ভয়ার ঘটনা দেশ, সমাজ, পরিবারের ভাবনার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। আদালতের রায় উপেক্ষা করে মেয়ের প্রকৃত নাম প্রকাশে পরিবার ব্যতিক্রমী ভূমিকা নেয়। অত্যাচারিত মেয়ে নিজের নাম লুকিয়ে বেনারসির আঁচলে এক ভয়াবহ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে নতুন সংসারে পাড়ি দেবে। নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিকারের বদলে মুখ বুজে শান্তির সংসার করবে এই মিথ্যাচারণার শেষ হওয়া দরকার। কেননা সিদ্ধান্তহীনতার ভুগতে বাধ্য করা মানে মানবিক স্বার্থকে ব্যাহত করা। অত্যাচারিতর নাম গোপনের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে অপরাধের বিচারের দাবী জানানোর অভ্যাস গঠন জরুরি। ভুক্তভোগীর পরিবার আত্মগ্লানির শিকার কেন হবে? সদর্পে বিচারের জন্য আদালতের দরজায় কড়া নাড়বে। অপরাধীর বিরুদ্ধে জনমত গড়বে। এই সত্যই একমাত্র বাস্তব বলে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নির্ভয়ার ঘটনা। নির্ভয়া নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা। লেসলি উডউইনের ‘ইন্ডিয়ান ডটার’ ও দিপা মেহেতার ‘অ্যানাটমি অফ ভায়োলেন্স’ দেশের মানুষের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর পরিবর্তনের দাবি নিয়ে দিল্লীর রাস্তায় নেমেছিল ছাত্র-যুবর দল। মেয়েদের লাগাতার ভয়ের এক বাতাবরণে আটকে পড়া জীবন থেকে মুক্ত করার দাবি ছিল। এই আন্দোলনের জেরে এসেছিল নতুন আইন। কিন্তু মেয়েদের প্রতি নেমে আসা অপরাধের তালিকা ছোট হয়নি। সব চেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হল কি করে এক ছেলেকে ধর্ষক হয়ে ওঠা থেকে বিরত করা সম্ভব। মাগ্রেথ সিলবার্সমিড এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন বেশিরভাগ মানুষ ‘পুরুষের প্রত্যাশা’ পূরণ করতে পারে না। পরিবারের প্রধান হিসেবে ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে নানা অপূর্নতায় ভুগতে থাকেন । আত্মসম্মানের অভাব ও মহিলাদের অবজ্ঞা পুরুষের যৌননির্বাচনকে নিয়ন্ত্রন করে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বেকারত্বও অনিশ্চিত যৌন আচরণের বড় কারন। কেউ জানে না আজকের সুন্দর শিশুটি কাল এক ভয়াবহ এক ধর্ষক হয়ে উঠবে কিনা। অপরাধীকে অপরাধ প্রবণতা থেকে সরিয়ে আনার জন্য আলাদা এক মডেল নির্মাণ করা জরুরি। লাগাতার সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবিসহ আক্রমণকারী ও আক্রান্তদের এক ছাদের তলায় বসানো প্রয়োজন। সঠিক আলোচনা ও সর্বস্তরে প্রচার মানুষের উপলব্ধি ও বোধ নির্মানের বড় অস্ত্র।

অত্যাচারিতর মনোবল জোগানোর বদলে যুক্তিহীন বক্তব্যকে প্রশ্রয় দেওয়ার রাজনীতির শিকার মেয়েরা। এই বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলাও পীড়াদায়ক। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি প্রাণে না মরা পর্যন্ত সেটি সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়। মরে গেলে রাজনীতির ময়দানে সরগরম। মেয়েদের সমস্যা বাস্তবে কখনও জাতীয় সমস্যা হয়ে ওঠে না। দেশে প্রথম চারজনের একসঙ্গে ফাঁসি রাষ্ট্রগৌরবের ইতিহাসে কি যুক্ত করবে নতুন পালক? চোখের কালো কাপড় সরিয়ে কি সত্যি বিচারের দেবী রাষ্ট্রের সাফল্যে হাততালি দিয়ে উঠবে? আগামীর ইতিহাস আদালত চত্বরে কান্নায় ভেঙে পড়া নয়, হাসিমুখের জয় দেখার অপেক্ষায়। ফাঁসি উদযাপন বা প্রতিহিংসার জয় নয়। ফাঁসি অপরাধের বিনাশ ডেকে আনুক। অবিচারের সব শর্তগুলি ব্যর্থ করুক। ন্যায়ের উৎসবে মেতে উঠুক গোটা সমাজ। ফাঁসিকাঠে অপরাধীর দিন নয়,অপরাধের শেষ হোক।

শিক্ষক, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

অন্য বিষয়গুলি:

Nirbhaya Rape Case Hanging Justice
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE