প্রতীকী ছবি
নতুন কৃষি আইন নিয়ে দেশ জুড়ে অসন্তোষ চলছে। তার পুরোভাগে আছেন কৃষকসমাজ, এবং তাঁদের সহযোগী সংগঠন ও রাজনৈতিক দল। আমরা যারা কৃষক নই, আমাদের কি তবে মাথাব্যথার কারণ নেই? একটা কথা তো মনে হতেই পারে। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও প্রাথমিক পর্যায়ে বিক্রি করেন কৃষক। কিন্তু সেই পণ্যের বেশির ভাগটাই খাদ্যবস্তু, যা কিনি আর খাই আমরা সকলে। এটা কি হতে পারে, এত বড় একটা আন্দোলনের যা হেতু, আমাদের গায়ে তার কোনও আঁচ লাগবে না? তিনটি আইনের একটির সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি সম্পর্কই নেই, ফসল তাঁদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে যাওয়ার পর এই আইনটির প্রাসঙ্গিকতা।
আইনের ব্যাপার আইনজ্ঞরাই ভাল বুঝবেন। তবে এই আইনগুলির ভাষা মোটামুটি সহজ সরল, আয়তনও খুব দীর্ঘ নয় (একটা তো নেহাত ছোট)। পড়ে সাধারণ মানুষের মনে একটা ভয় ঢুকতে পারে। সেটা ব্যক্ত করে, ওয়াকিবহাল লোকের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার আশায় এই লেখা।
কৃষকদের প্রধান চিন্তা, নতুন আইনে বড় ব্যবসায়ীরা এমন ভাবে বাজার কব্জা করে ফেলবেন যে, তাঁরা বাধ্য হবেন কম দামে তাঁদের কাছে ফসল বিক্রি করতে। কৃষকদের আন্দোলন এই আশঙ্কার ভিত্তিতে। সরকার বলছে ঠিক উল্টো কথা: এই আইনের ফলে বাজার মুক্ত হবে, নতুন ক্রেতারা এগিয়ে আসবেন, খোলা বাজারের নিয়মে চাষিরা আরও লাভবান হবেন।
সরকারের কথা শিরোধার্য, ধরা যাক সেটাই হল। কল্পনা করা যাক, অগাধ মূলধন আছে, এমন কোনও ব্যবসায়ী সংস্থা ফসল কিনতে বাজারে নামল; চলতি দরের চেয়ে পাঁচ-সাত শতাংশ বেশি দাম দিয়ে বিপুল পরিমাণ ফসল (ধরা যাক, ধান) কিনে ফেলল। বেশি দাম পেয়ে চাষিরা খুশি হয়ে বিক্রি করলেন। ভাবলেন, সত্যিই তো, নতুন ব্যবস্থায় লাভই হল, অকারণে প্রতিবাদ করেছি।
ওই ধনবান সংস্থাটি এবার গুদাম ব্যবস্থাও করায়ত্ত করে সেই বিপুল পরিমাণ ধান মজুত রাখল বহু মাস ধরে, অল্পে অল্পে বাজারে ছাড়ল। চালের হাহাকার দেখা দিল। চালের দাম অবশেষে দাঁড়াল গত বছরের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি। মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠল, গরিব মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে থাকল।
আপাত ভাবে মনে হয় এই তিনটি আইনে, বিশেষত অত্যাবশ্যক পণ্য সংক্রান্ত সংশোধিত আইন অনুসারে, এই পুরো প্রবাহে কোথাও কোনও অপরাধ ঘটছে না। যাকে আমরা এত দিন মজুতদারি ও কালোবাজারি বলে এসেছি, তা সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যপণ্যের দাম এক বছরে, বা পাঁচ বছরের গড় দামের, ৫০ শতাংশ না বাড়লে (পচনশীল খাদ্যের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ) সরকারি হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই। খাদ্য রফতানির উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি না, তাও স্পষ্ট নয়।
এমন নাটকীয় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা হয়তো কম। হাজার হোক, অতি বৃহৎ ব্যবসায়ীর পক্ষেও দেশ জুড়ে সরবরাহ কব্জা করা সহজ নয়, বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করতে তাঁরা এমনিও চাইবেন না। কিন্তু এমন পরিস্থিতি যদি কিছু মাত্রায়ও দেখা দেয়, ৪৭% না হোক ২৭% এমনকি ১৭% মূল্যবৃদ্ধি হয়, দুর্গতির মাত্রা থাকবে না।
একই সঙ্গে আরও কিছু আশঙ্কা হতে পারে। চালের দাম বাড়লে বাজারে আর সব কিছুরও দাম বাড়বে। আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র চাষি, তাঁদেরও কিছু খাদ্য কিনে খেতে হয়। ফসল বিক্রির সময় তাঁরা যে বাড়তি দাম পেয়েছিলেন, সেই লাভের কড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। অন্যান্য ভোক্তার তো কথাই নেই।
আর একটা আশঙ্কা আমাদের রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে। চাষিরা যদি বেশি দামের আকর্ষণে সব চাল অন্যত্র বেচে দেন, সরকারি সংগ্রহ মার খাবে, জনবণ্টন ব্যবস্থায় সঙ্কট দেখা দেবে। দেশ জুড়ে গরিব মানুষ যে এক টাকা দু’টাকা দরে, কখনও-বা বিনামূল্যে, রেশনের চাল পান, তার জোগানে টান পড়বে। একই ভাবে টান পড়তে পারে ভাতের সঙ্গে মেখে খাওয়ার সামান্যতম উপকরণে— ডাল, আলু, ভোজ্য তেল— সব কিছুই এক আইনবলে মুক্তিলাভ করছে।
ভরসা রাখতে হয়, গণতান্ত্রিক দেশে এমন হতে পারে না। কিন্তু ভরসার স্থল ঠিক কোথায়, সেটা স্পষ্ট জানলে লোকে আশ্বস্ত হবেন। আমাদের সরকার জনদরদি, আমাদের নেতা মহান, অতএব কখনই এমন ঘটবে না— এটুকু শুনে আমরা নিশ্চিন্ত নাও হতে পারি। কোন বাস্তব উপায়ে এমন বিপর্যয় ঠেকানো যাবে, সেটা বলা দরকার; অথবা যুক্তি-তথ্য দিয়ে বোঝানো দরকার যে, আইনের উপরোক্ত ব্যাখ্যা ভুল, রক্ষাকবচের বিলক্ষণ ব্যবস্থা আছে। কতকগুলি বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে ঠিকই, তার একটা হল দুর্ভিক্ষ। কিন্তু সেই আইনসিদ্ধ পরিত্রাণের জন্য কি প্রথমে একটা আইনসিদ্ধ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে হবে?
ভারতের, বিশেষ করে বঙ্গভূমির, ইতিহাসে বড় মর্মান্তিক নজির আছে, যখন খাদ্যের উৎপাদন যথেষ্ট কিন্তু লোকে ব্যাপক হারে না খেয়ে মরেছেন। সিঁদুরে মেঘ দেখলে তাই ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশদ বাস্তবভিত্তিক আশ্বাসের বড়ই দরকার।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy