Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

রাজ্যে তিনিই কি বিজেপির মুখ?

এই দলেরই রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একটু অন্য রকম। শাসানি, কু-কথায় লাগামছাড়া হলেও যাঁরা সহজ স্রোতে গা ভাসিয়ে হুল্লোড় করতে ইচ্ছুক, তিনি তাঁদের তালিকায় নাম লেখাতে আগ্রহী নন।

দিলীপ ঘোষ।

দিলীপ ঘোষ।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৯ ০০:৩১
Share: Save:

রাজভবনে স্বাধীনতা দিবসের চা-চক্রে দিলীপ ঘোষের সঙ্গে দেখা। মাঝে অনেক দিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। এই সময়ের মধ্যে বহু উথালপাথাল ঘটে গিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। লোকসভা ভোটে বিজেপির বড় উত্থান তো আছেই, তারই সঙ্গে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার হিড়িক, জেলায় জেলায় শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভের উদ্‌গিরণ। আগামী বিধানসভা নির্বাচনের ভবিতব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে জল্পনাও তাই জোরদার হয়েছে। বিজেপির অনেক নেতাই ধরে নিয়েছেন, লোকসভায় আঠারোটি আসন পাওয়ার পরে রাজ্য দখল কার্যত তিন তুড়ির খেল!

কিন্তু এই দলেরই রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একটু অন্য রকম। শাসানি, কু-কথায় লাগামছাড়া হলেও যাঁরা সহজ স্রোতে গা ভাসিয়ে হুল্লোড় করতে ইচ্ছুক, তিনি তাঁদের তালিকায় নাম লেখাতে আগ্রহী নন। আরও সঠিক ভাবে বললে, তিনি ওই আলগা উচ্ছ্বাস থেকে কিছুটা দূরে থাকাই বেশি পছন্দ করেন। ভোট, সংগঠন, দলবদল ইত্যাদি নিয়েও নিজস্ব মতামত আছে তাঁর। যা হয়তো বিজেপির চেনা ধারার সঙ্গে সর্বদা মেলে না। তবে তাতে তাঁর বিশেষ হেলদোল নেই বলেই মনে হয়!

আর এই সব কিছু নিয়েই দিলীপবাবু এখন রাজ্য রাজনীতিতে এক বর্ণময় চরিত্র। গুরুত্বপূর্ণও বটে। কারণ প্রধান বিরোধী দলের সাংগঠনিক ভার বৃষস্কন্ধে নিয়েও তিনি অকপটে বলতে পারেন, রাজ্যে ক্ষমতায় আসার মতো যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি তাঁর দল এখনও অর্জন করেনি। এমনকি অন্য দল থেকে মুড়ি-মুড়কির মতো লোক ভাঙিয়ে নিজের দলের জোর বাড়ানোর চেষ্টা কতটা ‘লাভজনক’ হতে পারে, তা নিয়েও সংশয় আছে তাঁর।

এই যেমন শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিজেপিতে যাওয়া। তৃণমূল ছেড়ে শোভনের বিজেপিতে যোগদানের পিছনে দিলীপ ঘোষের অবদান কতটা, তা নিয়ে বহু মত হাওয়ায় ঘুরছে। কেউ কেউ তো বিশ্বাস করেন, শোভন ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজেপিতে টেনে নেওয়ার মূল কারিগরই দিলীপবাবু। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে তিনি যে কথা বলেছেন, তার অভিঘাত ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

এটা ঠিক যে, এই রাজ্যে শোভনের মতো ওজনদার নেতার বিজেপিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে দলের রাজ্য সভাপতির কিছুটা ভূমিকা থাকেই। চূড়ান্ত সম্মতিও দিতে হয় তাঁকেই। এটাও ঘটনা যে, রাজ্য বিজেপির এক সহ-সভাপতির মধ্যস্থতায় শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে দিলীপবাবুর গত কয়েক মাসে বার চারেক মোলাকাত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শোভনদের দলে নেওয়ার সুপারিশ করে বিজেপির উঁচু মহল থেকে ফোন এসেছিল দিলীপ ঘোষের কাছে। তখন তিনি ঘাড় হেলান।

তবে ‘আগমার্কা’ আরএসএস দিলীপবাবু দু’হাতেই লাঠি চালাতে সমান দক্ষ। তাই দিল্লিতে শোভনদের যোগদানের মঞ্চে রাজ্য বিজেপির সভাপতি হিসেবে নিজে অনুপস্থিত তো ছিলেনই, উপরন্তু কলকাতায় বসে সে দিন বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে আমরাই সরব হয়েছি। শোভনের বিরুদ্ধেও নারদ-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দল তাঁকে বার করে দেবে।’’

শোভনদের দলবদলে হাজির ছিলেন মুকুল রায়। এর আগে তাঁরই বন্দোবস্তে তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে ভাঙিয়ে আনার ঘটনায় বিজেপির অন্দরে ক্ষোভ ব্যাপক আকার নিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল মনিরুলের বিতর্কিত ভাবমূর্তি নিয়ে। দিলীপ ঘোষ তখনও এই ধরনের কাজের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। শোভনের বেলায় তিনি কার্যত সেই কথাটিই ফের স্মরণ করালেন।

দিলীপবাবুর এমন ডাকাবুকো অবস্থান রাজ্য বিজেপির ভিতরকার টানাপড়েনের বহিঃপ্রকাশ কি না, তা নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করতেই পারেন। বস্তুত দলের ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনাগত ভবিষ্যতের ‘স্বপ্ন’ দেখতে উৎসাহীদের সংখ্যা যে বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আর সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক ঠোকাঠুকিও অনিবার্য।

তবে সে দিন রাজভবনে সামান্য আড্ডায় দিলীপবাবু বলছিলেন, ‘‘রাজনীতি আমার কাছে একটা খেলা— স্পোর্টস। সবাই সব সময় সব খেলায় জিতবেই, তা হতে পারে না। কিন্তু জেতার দমটা মনে ধরে রাখতে হয়। আমি রাজনীতিটাকেও এই ভাবে দেখতে ভালবাসি।’’

হয়তো তাই ‘জিততে না পারলেও লড়াই হবে’ জাতীয় কোনও কথা তাঁর ঘোরতর অপছন্দের। দলের কোনও প্রার্থী বা কর্মী যদি তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, অমুক আসনে জিততে না পারলেও ভাল লড়াই হবে, তিনি সটান সেই লোকটিকে বলে দেন, ‘‘তুমি ছেড়ে দাও। জেতার জিদ যার নেই, তার দ্বারা কিছু হবে না।’’ অনেকেই জানেন, এ বার লোকসভা ভোটে বিজেপি রাজ্যে অনেকটা ভাল ফল করা সত্ত্বেও রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অভিনন্দনের মালা গলায় পরার আগে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘‘তোমরা কোন জেলার?’’ যদি তাঁর মনে হত, যে জেলার লোকেরা মালা নিয়ে এসেছেন, সেখানে দলের ফল আশানুরূপ হয়নি, তা হলে তাঁদের বলে দিতেন, ‘‘তোমাদের মালা নেব না। আগে ভাল ফল করে দেখাও, তার পরে মালা দিয়ো।’’

রাজ্য বিজেপির সভাপতি হওয়ার আগে দিলীপ ঘোষ কিন্তু সাধারণের কাছে খুব পরিচিত মুখ ছিলেন না। ১৯৮৪ থেকে আরএসএস-এর সংগঠক হিসেবে তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল একেবারেই পৃথক। এক সময় সরসঙ্ঘচালক সুদর্শনের সহকারীর দায়িত্বও পালন করেছেন। রাজনীতির মূল স্রোতে এনে তাঁকে প্রথমে এই রাজ্যে সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয় বিজেপি। বছর না ঘুরতেই সরাসরি রাজ্য কমিটির সভাপতি। ২০১৫ থেকে এখনও তিনি সেই পদে বহাল।

কেন্দ্রে বিপুল গরিষ্ঠতায় ক্ষমতাসীন তাঁর দল। রাজ্যেও শক্তি বেড়েছে। রাজভবনে অভ্যাগতদের সমারোহে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ে আগ্রহীর সংখ্যাও অনেক। কেউ যেচে আলাপ করে যাচ্ছেন, কারও বায়না সেলফি তোলার। হাওয়ায় ফিসফাস, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তিনিই কি এখানে বিজেপির ‘মুখ’? প্রত্যাশিত ভাবেই এ সব কথায় আমল দেননি দিলীপবাবু। মজা করে বলেছেন, ‘‘আমাকে এ বার মিডিয়াতে চাকরি নিতেই হবে।’’

কিন্তু সম্ভাবনাটি কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার? বাস্তব সে কথা বলে না। কারণ বিজেপির সাম্প্রতিক উত্থানে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৬-র বিধানসভা এবং এ বারের লোকসভায় পর পর জিতে তিনি জনসমর্থনের পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ। দু’বারই হারিয়েছেন দুই জাঁদরেল নেতাকে। বিধানসভায় খড়্গপুরের প্রবাদপ্রতিম বিধায়ক কংগ্রেসের জ্ঞানসিংহ সোহনপাল, লোকসভায় তৃণমূলের মানস ভুঁইয়া।

এ বার যখন লোকসভায় দল তাঁকে লড়তে বলে, গোপীবল্লভপুরের ভূমিপুত্র প্রথমে ‘না’ বলেছিলেন। যুক্তি ছিল, রাজ্য ঘুরে প্রচার করতে হবে। দল সে কথা মানেনি। অতএব মেদিনীপুরে লড়তে হল। খেলোয়াড়ি মেজাজেই দিলীপবাবু দলের কর্মীদের বললেন, ‘‘চলো, এ বার মানসদাকে হারিয়ে আসি!’’

তবে বিজেপির ঘরের কোঁদলে দলের ‘মুখ’ হয়ে ওঠার ‘সমান্তরাল সংগ্রাম’ যে থাকবেই, তা নিশ্চিত। যদিও পর্যবেক্ষকদের বিচারে রাজ্য বিজেপিতে ‘দৃশ্যমান’ যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ‘মুখ’ আর কে আছেন, এই মুহূর্তে তা অনুসন্ধানসাপেক্ষ। যাঁরা বার বার ভোটে হারেন, বা দূরে কোনও রাজভবনের নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে বসে নির্লজ্জ ভাবে দলীয় রাজনীতির প্রচার চালান, তাঁদের মতো কেউ, না কি অন্য কোনও পরিযায়ী, সে সব সময়ই বলবে।

সে দিন চা-চক্রের আড্ডায় দিলীপ ঘোষ অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, তাঁর রাতের ঘুমে কোনও ব্যাঘাত হয় না। তিনি নিশ্চিন্তেই ঘুমোতে পারেন!

অন্য বিষয়গুলি:

Dilip Ghosh BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy