Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

কাটমানি প্রসঙ্গ কি মমতার নতুন রাজনৈতিক অঙ্ক?

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যের নানা প্রান্তে কাটমানি ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। বসে নেই বিজেপিও। লিখছেন দেবজ্যোতি কর্মকার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যের নানা প্রান্তে কাটমানি ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। বসে নেই বিজেপিও। লিখছেন দেবজ্যোতি কর্মকার

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৯ ০১:২৪
Share: Save:

সম্প্রতি আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা মাত্রই একটি শব্দবন্ধ জনপ্রিয় হয়ে পড়ল। শব্দবন্ধটি হল— ‘কাটমানি’। বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে এখন এটাই সবথেকে চর্চিত শব্দবন্ধ। অথচ এমন নয় যে, এই শব্দবন্ধটি এর আগে কেউই শোনেননি। তৃণমূলনেত্রী কাটমানির প্রসঙ্গ এমন সময়ে উত্থাপন করলেন যখন তাঁর দলই রাজনৈতিক ময়দানে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এমনিতেই রাজনীতির ময়দান সবসময় খুব একটা মসৃণ হয় না। অনেক ওঠা-পড়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই এগোতে হয়।

বলা বাহুল্য, এই মুহূর্তে রাজ্যের শাসক দলের পথটি কিন্তু বেশ বন্ধুর। প্রায় প্রতিদিনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-সহ শাসক দলের নেতাদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে হঠাৎ পদ্মের দাপাদাপি! বলা ভাল, প্রায় ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে গেরুয়া বাহিনী। এমনকি অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, এ যেন ২০০৯ এর ফ্ল্যাশব্যাক। অর্থাৎ, বাম জমানার শেষের দিকে যেমন হয়েছিল, এটা নাকি তারই পুনরাবৃত্তি! যদিও এ সব জল্পনার অবসান ২০২১ সালের আগে ঘটবে না। তাই তার আগে ‘টিয়াপাখি’ বনে যাওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কাটমানি ফেরতের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষই সেই বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। বিজেপিও বসে নেই। থাকার কথাও নয়। সবথেকে মারাত্মক দিক হল, কাটমানির সৌজন্যে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আরও প্রকাশ্যে চলে আসা। কাটমানি ইস্যুতে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ অভিযোগের জন্য টোল ফ্রি নম্বর-সহ একটি পৃথক সেল খোলা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ে রাজনৈতিক ভাবে কিছুটা ব্যাকফুটে থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলনেত্রী হঠাৎ কেন কাটমানির বিষয়টি উত্থাপন করলেন? যেখানে এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়া মানেই তো শাসকদলের ব্যর্থতাকেই স্বীকার করে নেওয়া। রাজনৈতিক ময়দানে পোড়খাওয়া নেত্রী তবে কি জেনেবুঝেই ভুল করলেন? এটা তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত অন্য কোনও নতুন পাটিগণিত? নাকি তিনি নিজেও এক বার জল মেপে নিতে চাইছেন?

এখান থেকেই হয়তো তিনি নতুন কোনও রাজনৈতিক দিশা খুঁজবেন। এখন উত্তীর্ণ হবেন কি না সেটাই দেখার। তবুও তিনি যে পরীক্ষায় বসার সাহস দেখালেন তার জন্য কুর্নিশ জানাতেই হয় তাঁকে। আসলে নির্বাচন নির্ভর আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের একমাত্র পরীক্ষা হয় নির্বাচন যুদ্ধেই। কেননা ভোটের পরে সাধারণ মানুষ এত দিন শুধু দেখে এসেছেন তাঁদের দাবিগুলোর কী ভাবে মৃত্যু ঘটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাটমানি ইস্যু খানিকটা সেই উপেক্ষিত সাধারণ মানুষের সামনেই পরীক্ষায় বসার ইঙ্গিত। প্রচলিত মিথ ভেঙে ফেলার একটা তাগিদ। সাধারণ মানুষের সামনে ভোটের পরে আবার আগামী ভোটের জন্য পরীক্ষায় বসা।

যে উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন তা একটি নতুন পরীক্ষা। হতেই পারে তিনি তাঁর সততার ইমেজটিকে তুলে ধরতে চাইছেন। যা সারদা-নারদার মতো নানা কারণে কিছুটা হলেও ফিকে হতে শুরু করেছিল। আবার হতেই পারে পঞ্চায়েত নির্বাচনে যাঁরা ভোট দিতে পারেননি তাঁদের ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমিত করার তাগিদ। সাধারণ মানুষের মন জয় করে নেওয়ার সহজ পাটিগণিত হিসেবেও এই অস্ত্র প্রয়োগ হতেই পারে। কেননা, সাধারণ মানুষকে এ রকম একটি উত্তেজক পরিবেশে ঠেলে দিলে আখেরে রাজনৈতিক দলেরই লাভ হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই উল্টো ফলও হয়। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এটা একটা উভয় সঙ্কটও বটে।

এই মুহূর্তে যেহেতু পদ্মশিবির শাসক দলের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে সেহেতু মুখ্যমন্ত্রীকে ভাবতেই হচ্ছে পাল্টা কী বিষয় উত্থাপন করা যায়। যা তাঁকে রাজনৈতিক ফায়দা দেবে। এ কথাও ঠিক, তিনি যে বিষয়গুলো নিয়ে বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময়ে সবথেকে বেশি সরব ছিলেন তার মধ্যে অবশ্যই একটি ইস্যু কাটমানি। তিনি বিরোধী থাকাকালীন হয়তো সরাসরি খুব একটা ব্যবহৃত হয়নি এই শব্দটি, কিন্তু বাম আমলের কর্মসংস্কৃতিতে যে মরচে ধরেছিল তা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। বার বার নানা আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন, পুলিশ প্রশাসন থেকে সরকারি যে কোনও অফিসে কাটমানি বা অর্থের বিনিময় ছাড়া কাজ হওয়া প্রায় অসম্ভব। তৎকালীন সরকারের কাজের গতিও যে শ্লথ হয়ে পড়েছিল তা-ও সাধারণ মানুষের অজানা নয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সিংহাসনে বসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির কদর্য চেহারায় বদল আনবেন, এমনটাই স্বপ্ন ছিল সাধারণ মানুষের। ‘পরিবর্তন চাই’ স্লোগানের উত্থান কিন্তু সেখান থেকেই।

অথচ এত দিন পরেও সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই, এখনও সেই কাটমানি ছাড়া কাজ হয় না বহু সরকারি অফিসে। আর এই কাটমানির সৌজন্যেই রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন একশ্রেণির নেতা যাঁরা আবার ভোট ব্যাঙ্কের বড় আমানতকারী। তাঁরাই আবার যখন তখন রং পাল্টে নেন সুবিধে মতো। রাজনৈতিক দলের বদান্যতায় ওঁদের এত বাড়বাড়ন্ত। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, এগুলো বলা মানে ব্যর্থতাকেই মেনে নেওয়া। তবুও তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। কেননা, তাঁর স্থির বিশ্বাস এ সবেরই প্রভাব পড়েছে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে।

সব দিক থেকে বিচার করলে এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, এক দিকে ক্ষমতায় থাকার মরিয়া চেষ্টা করে ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট’কে চাগিয়ে দেওয়া, অন্য দিকে একটি সহজ ‘ভয়’কে উপেক্ষা করার স্পর্ধা দেখালেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। ‘ভয়’, কারণ এই কাটমানি নেওয়া নেতাদের অনেকেই এত দিন শাসক দলেই থেকেছেন। ওঁরাই দলের নির্ধারক। ওঁরা মুখ ফিরিয়ে নিলে ভোট মেশিনারিতে বেশ বড় একটা ‘ধাক্কা’ লাগবেই। সেই ‘ধাক্কা’ বনাম সাধারণ মানুষের আবেগতাড়িত ‘কাটমানি ফেরত চাই’-এর আন্দোলন কোনটি ভবিষ্যৎ নির্ণায়ক হতে চলেছে সেটাও দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

Cut Money TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy