বঙ্গ বিজেপি-র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘ভার্চুয়াল’ সমাবেশ রাজ্যে প্রায় এক বছর আগেই ভোটের ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। কোভিড-১৯ এবং আমপানকে হাতিয়ার করে কেন তাঁরা এখনই ভোটের রাজনীতি শুরু করে দিলেন, তার কারণ বোঝা হয়তো খুব কঠিন নয়। একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট যে, নির্বাচনকে তাঁরা শুধু রাজনৈতিক মোকাবিলাতেই সীমাবদ্ধ রাখবেন না। কেন্দ্রে ক্ষমতার বলে অন্য নানা প্রক্রিয়ায় এমন কিছু পদক্ষেপ করতে তাঁরা তৈরি হচ্ছেন, যার পরিণাম বহু দূর গড়াতে পারে। আগামী বছরখানেক ধাপে ধাপে এর বিবিধ প্রকাশ দেখা যাবেই।
ঘটনাচক্রে ভোটের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সিবিআই-ইডি’র মতো তদন্তকারী সংস্থাগুলির তৎপর হয়ে ওঠার নজির আছে। অভিযোগের তদন্ত এবং দোষ প্রমাণিত হলে আইনানুগ শাস্তি— সবই উচিত কাজ। কিন্তু সময় বুঝে তদন্তের গতি হঠাৎ বাড়ানো হলে বুঝতে হয়, অঙ্কটা সরল নয়! শাহের সে দিনের বক্তৃতায় সারদা-নারদ তদন্তের একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল। অনেকের ধারণা, তদন্তের জাল আগামী কয়েক মাসে অনেকটাই প্রসারিত হবে।
শাহের ভাষণের পরেই সরকার এবং নির্দিষ্ট করে বললে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আবার তেড়েফুঁড়ে নামার উদ্যম বেড়েছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়েরও। বিভিন্ন কারণে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা এবং কঠোর পরিণামের হুমকি দেওয়া কার্যত তাঁর দিনলিপি। এ বার একটি মদ প্রস্তুতকারক সংস্থায় আবগারি দফতরের কিছু পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের মতো প্রজা-বিক্ষোভের দৃষ্টান্ত টেনে এনেছেন। যার সোজা অর্থ, স্বয়ং রাজ্যপাল মনে করেন, রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-বিক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে! এ অতি ভয়ঙ্কর মন্তব্য।
রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের পদে বসে এই রকম বক্তব্য সরকারের বিরুদ্ধে প্ররোচনা বলে গণ্য হয় কি না, সেটা সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু তাঁর দিল্লির মনোনয়ন-কর্তারা মৌনী থাকলে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, ধনখড়ের এমন কাজকর্মে তাঁদের হয়তো সম্মতি আছে। অনেকের অনুমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ছক অনুযায়ী রাজ্যপালের ভূমিকা আগামী ভোটে ‘অর্থবহ’ করে তোলা বৃহত্তর পরিকল্পনার বাইরে নয়। সব মিলিয়ে তাই রাজ্য রাজনীতিতে এখন এক ক্রান্তিকাল। শাসক, বিরোধী উভয়ের কাছেই সময়টি খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলায় ভোটের আগে শাহ যে বিশেষ ‘সক্রিয়’ হবেন এবং কার্যত সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ভোট করাবেন, সে কথা শোনা যাচ্ছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এখানে আঠারোটি আসন জেতার পরে তিনি নিজেও বলেছিলেন, একুশের বিধানসভা ভোটের জন্য তিনি বার বার এই রাজ্যে আসবেন।
তবে মে মাসে নির্বাচনের হিসাব কষে শাহ ও তাঁর দলের রাজ্য নেতারা এর আগে বলতেন, ডিসেম্বর অর্থাৎ ভোটের মাস ছয়েক আগে থেকে মাসে দু-তিন বার করে তাঁর পশ্চিমবঙ্গে আসার কর্মসূচি তৈরি হবে। সেখানে সাংগঠনিক প্রস্তুতির দিকটি গুরুত্ব পাবে। প্রচারও চলবে। তার পরে ঘন ঘন আসতে থাকবেন নরেন্দ্র মোদী।
কিন্তু সে দিন অমিত শাহ যে ভাবে নির্বাচনের প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন, তাঁরা রাজ্যে ক্ষমতায় এলে কী করবেন তার বার্তা দিতে চেয়েছেন, সিবিআই তদন্তের জুজু দেখিয়েছেন এবং তাঁর ওই ভার্চুয়াল সমাবেশের বক্তব্য বিজেপি যে কায়দায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাতে সামগ্রিক ভাবে বোঝা যায়, এটা সুসংহত সিদ্ধান্ত। আগামী বছরখানেক তাদের সব কর্মসূচিই হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক।
করোনা এবং আমপানের জোড়া ধাক্কার মধ্যেই বিজেপি এত আগেভাগে ভোটের কথা সামনে আনছে কেন? উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। সেটা খুব সহজবোধ্য। দু’টি সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাজ্যের অবস্থা এখন রীতিমতো নাজেহাল। আর্থিক, সামাজিক বিবিধ চাপের মুখে মানুষের অনেক রকম চাহিদা ও ক্ষোভ তৈরি হয়। সব সময় তা যে যুক্তির ধার ধারে, তা হয়তো নয়। কিন্তু সেগুলি উস্কে দেওয়া একটি সচেতন রাজনৈতিক কৌশল। আর সেটা করতে চাইলে সঙ্কটের মধ্যেই করার চেষ্টা হয়। যাতে তার জের গড়ায় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী টেনে নিয়ে যাওয়ার পথ খোলা থাকে।
রাজ্য বিজেপি অবশ্য স্থানীয় ভাবে তৃণমূল-বিরোধিতায় সেই কাজটি নিয়মিত করছিল। শাহ তার মাত্রা বাড়িয়ে সরাসরি ভোটকে নিশানায় এনে দিলেন। করোনা ও আমপানের বর্তমান প্রেক্ষিতে শাসক, বিরোধী সকলেই নিজেদের মতো করে এই সঙ্কটকালকে ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক। আর, নাগরিকত্ব প্রশ্নে বিজেপি যে ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে এটা সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে জুতসই পরিসরও বটে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু দিন ধরেই কটাক্ষের সুরে বলছেন, “ক্ষমতা পেতে বিজেপি-র এত তাড়া কিসের!” ঠিকই, এক বছর লম্বা সময়। তার মধ্যে অনেক কিছু অদলবদল হয়ে যেতে পারে। আজ যা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, অবস্থাভেদে তার ওজন কমতে পারে। তবে করোনার প্রকোপ ও আমপানের ক্ষত দুটিই যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি বিষয়, তাই ভোটের রাজনীতিতে এগুলির অনেকখানি ভূমিকা থাকবেই। সেই জন্যই ক্ষোভ-অভিযোগ বাসি হওয়ার আগে বিজেপি-র এই বাড়তি তৎপরতায় আপাত ভাবে হয়তো দোষের কিছু নেই।
তবে এ ক্ষেত্রেও কী ভাবে বিষয়গুলি সামনে আনা হচ্ছে, তা লক্ষণীয়। যেমন করোনার ক্ষেত্রে শাহ প্রধান অস্ত্র করেছেন পরিযায়ী-রাজনীতি। কারণ তাঁরা মনে করেন, এর মধ্যে অনায়াস আবেগ সৃষ্টি করার সুযোগ আছে। মমতা পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, এটা প্রচার করলে সেই আবেগে ইন্ধন জোগানো যায়। কিছু লোক এতে প্রভাবিত হবে না, সেটাও বলা যায় না। এমনকি, অন্য বিরোধীরাও চট করে শাহের এই কথার বিরোধিতায় মুখ খুলতে চাইবে না।
যদিও ঘটনা হল, রাজ্যে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা পনেরো-কুড়ি দিনের মধ্যে যে ভাবে হু হু করে বেড়েছে, তার পিছনে রোগ-অধ্যুষিত কয়েকটি রাজ্য থেকে বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকের ফিরে আসার একটি যোগ নিশ্চিত ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। রাজ্য সরকার পরিযায়ীদের ট্রেন পাঠানোর ক্ষেত্রে যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল, তা হয়নি। ফলে কোভিড-আক্রান্তের তালিকায় উপরের দিকে থাকা রাজ্যগুলি থেকে এক-এক দিনে কয়েক হাজার পরিযায়ী প্রায় একসঙ্গে বাংলায় এসেছেন। বিভিন্ন জেলায় তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন। সংক্রমণও তার পরেই এক লাফে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা শাহের না-জানার কথা নয়। আর তার দায়ও কেন্দ্র এড়াতে পারে না।
এই বাস্তবতা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্যই পরিযায়ীদের আবেগকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন শাহ। মমতা পরিযায়ীদের ‘অসম্মান’ করেছেন— এমন অভিযোগের খানিকটা নেতিবাচক প্রভাব ছড়ানো খুব শক্ত কাজ নয়। শাহ চেষ্টা করেছেন, লোহা গরম থাকতেই ঠিক সেখানে হাতুড়ির ঘা মারতে!
দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তার তালিকায় না-রাখার পিছনেও এই কোভিড-রাজনীতির ছায়া দেখা অসঙ্গত নয়। কেন্দ্রীয় দল আমপানের দুর্গতি দেখে যাওয়ার পরে এখন পর্যন্ত ওই খাতে একটি টাকাও কেন আসেনি, বলার সুযোগ পেলে সেই প্রশ্নও মমতা নিশ্চয় তুলতেন। অমিতবিক্রমের অধিকারী মোদী-শাহ সেই পথই বা খুলে দিতে যাবেন কেন! অতএব বক্তার তালিকা থেকে মমতাকে ছেঁটে তাঁদের হিসাবে কোনও ভুল হয়নি।
শুধু একটা প্রশ্ন। রাজ্যে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে বিজেপি নেতাদের যখন কোনও সংশয়ই নেই, তখন ঘি তুলতে এত আঙুল বাঁকানোর দরকার হচ্ছে কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy