প্রতিরোধ: নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে সরব মানুষের ঢল জামা মসজিদের সামনে, দিল্লি, ২০ ডিসেম্বর। পিটিআই। ইনসেটে: তনিকা সরকার
প্রশ্ন: গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনি রাস্তায়। এনআরসি এবং নয়া নাগরিকত্ব আইনের জেরে উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের গলি মহল্লায়। জানতে চাই, অভিজ্ঞতা কী রকম?
তনিকা সরকার: সত্যি বলতে কি, আমি এবং আমরা আতঙ্কিত, উত্তেজিত এবং এক অর্থে উল্লসিতও বটে। আমি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুবাদে কাছ থেকে ছাত্র আন্দোলন দেখেছি। সেখানে ২০১৬ সাল থেকে তো লাগাতার আন্দোলন চলছে। কিন্তু এই প্রথম দিল্লিতে গণআন্দোলনের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। নানা বর্গের, ধর্মের লোক পথে নামছেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে। এক এক জন এক এক রকম স্লোগান দিচ্ছেন। একে অন্যের স্লোগান শিখে নিয়ে বদলাবদলিও করে নিচ্ছি!
প্র: এর আগেই তো বিভিন্ন দাবিতে পথে নেমেছেন মানুষ। কেন মনে হচ্ছে এমনটা আগে ঘটেনি?
উ: মনে হচ্ছে, অল্প দিনের মধ্যেই এর ব্যাপ্তি এবং গভীরতা দেখে। আরও একটি বিষয় হল, সুদীর্ঘ নীরবতার পর সামান্য আওয়াজ হলেও চমকে উঠতে হয়। আর এ তো গণনাদ। সুদীর্ঘ নীরবতার পর এই আওয়াজ উঠেছে। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ প্রত্যাহার, সেই রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন অত্যাচার, গণপিটুনি, অযোধ্যার রায়— এই সব কিছুর পরেও কোনও স্বর শোনা যায়নি কোথাও। গোটা দেশে যেন শ্মশানের নীরবতা। এ বার গলা তুলতে পারছেন সেই মুসলিম সম্প্রদায়ও যাঁরা কচুকাটা হওয়ার পরেও এত দিন নীরব থেকেছেন ভয়ে। আমরা যারা এই বহুত্ববাদের একচ্ছত্র দাপটের বিরুদ্ধে, তারা আবার প্রতিবাদের রাস্তা ফিরে পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে যেন। উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীর, মেঙ্গালুরু— সর্বত্রই ভবিষ্যতের ছবি।
প্র: আগেও বহু বার রাস্তায় নেমেছেন। এ বারের আন্দোলনে ফারাকটা কোথায় টের পাচ্ছেন?
উ: বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তো দিনের পর দিন রাস্তায় থাকতাম। শান্তির কথা বলতাম। কিন্তু সে সময় স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী জনতার চোখে আমাদের সম্পর্কে ঘৃণা দেখেছি। নেহরু প্লেসের মতো জায়গায় শান্তি মিছিল করতে গিয়ে ঘেরাও হতে হয়েছে। আমাদের শোক মিছিল আক্রান্ত হয়েছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। রামযশ কলেজের কিছু ছাত্র উপর থেকে কাচের বোতল ছুড়ে মেরেছিল। যে ছাত্রীকে লক্ষ্য করে তা ছোড়া হয়, তার হাত গুরুতর জখম হয়েছিল। সুমিত সরকারের কলার ধরে ‘দেশ কি গদ্দার’ বলে অকথ্য গালিগালাজ করা হয়। মুসলিম শিক্ষকদের ওই মিছিল থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় পুলিশ সহযোগিতা না করলে প্রাণেই মারা যেতাম। কিন্তু এ বারে সাধারণ মানুষের চোখে ঘৃণা দেখছি না। যেমন ধরুন গত ১৯ ডিসেম্বর মান্ডি হাউসে বৃন্দা কারাট-সহ আমাদের অনেককেই গাড়িতে তুলে আটক করা হল। বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক মহিলা। হরিয়ানা সীমান্ত পার করে আমাদের নামিয়ে দেয় পুলিশ। আমরা পায়ে হেঁটে বাসে করে কনট প্লেস হয়ে যন্তরমন্তরে আসি। পথের জনতার মধ্যে কোনও প্রতিরোধ বা ঘৃণা দেখতে পাইনি কিন্তু। আবার এর মধ্যে অলকনন্দার উচ্চবিত্ত বাজারে গিয়ে আগে এই সরকারবিরোধী কথা বলতে গিয়ে প্রবল শত্রুতা দেখেছি। আমরা কথা বলা শুরু করলে বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ বারে আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। যখন ওই এলাকার ডিডিএ কলোনিতে, জামিয়া কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করলাম, তখন একে একে স্থানীয় মহিলারা মিছিলে শামিল হলেন। তাঁরা অমুসলিম সম্প্রদায়ের। জামিয়ানগরে বসবাস করা শিক্ষক, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, সাধারণ বাসিন্দা, হিজাব পরা গৃহবধূ মাথা উঁচু করে বলছেন, এই দেশ আমাদের। কেউ সংবিধান পড়ছেন। জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছেন। এমনটা সত্যিই আগে দেখিনি।
প্র: কিন্তু এমন তো নয় যে হঠাৎই সহনশীল হয়ে গিয়েছে গোটা ব্যবস্থা, যেখানে নির্ভয়ে গলা তুলতে পারছেন যে কোনও সম্প্রদায়? কী এর ব্যাখ্যা?
উ: জামা মসজিদের কাছে কিছু মুসলিম অটোওয়ালা, ট্রাক ড্রাইভার একটা কথা বলছেন। সেটা শুনলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ওঁদের বক্তব্য, পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে আমরা মরিয়া হয়ে গিয়েছি। আর গর্তে লুকিয়ে থাকতে চাই না। সকলের সঙ্গে মিলে প্রতিবাদ করতে চাই। কোনও চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসে নয়, আমরা প্রকাশ্যে রাস্তায় জলুসে যোগ দেব। যা হওয়ার হবে। এমনিতেই বা কি ভাল আছি!
দেখুন, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই ভাবছেন, যে এমনিতেই তো মরছি। প্রতিবাদ করেই দেখা যাক না। সেই সঙ্গে তাঁরা এটাও জানেন যে এই প্রতিবাদ করতে চাওয়ার কী প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করানোর প্ররোচনা পদে পদে। তাঁবেদার মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে গোটা ঘটনাকে ঘুরিয়ে দেখানোর সুযোগ রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে। ছবি বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তাও এঁদের আত্মবিশ্বাস এসেছে এই বোধ থেকে যে, তাঁরা একা নন। পাশে আরও অনেকে রয়েছেন। বিভিন্ন ধর্মের ছাত্ররা রয়েছেন। অলকনন্দাতে গৃহবধূদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি যে তাঁরাও সরকারের এই বৈষম্যমূলক নীতিতে অখুশি। বলছেন অযোধ্যার রায়েই তো মোদী বা অমিত শাহ যথেষ্ট জয়লাভ করেছেন। বিষয়টাকে নাগরিকত্ব পর্যন্ত টানার কী প্রয়োজন ছিল?
দিল্লির দোকানদারেরা বলছেন, জিএসটি নোট বাতিলের পর তাঁদের এমনিতেই কপালে হাত। দেশের অর্থনীতির অবস্থা তলানিতে। সে সবের সুরাহা না করে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করলে কি পেটে ডাল-রুটি জুটবে!
প্র: বড় প্রশ্ন এটাই যে, কত দিন ধরে রাখা যাবে এই আন্দোলন? কত দূর দেখতে পাচ্ছেন সামনে?
উ: অবশ্যই বেশি দূর এখনই দেখা যাচ্ছে না। সোজা কথা সোজা ভাবে বলাই ভাল যে, আরএসএস এবং বিজেপি রণক্ষেত্রে নামছে ভাল ভাবেই। তাদের প্রধান নিশানা পশ্চিমবঙ্গ। মানুষের মগজধোলাই করার ঠিক কী কী অস্ত্র আছে তাদের কাছে, তার কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ১৯৯০ সাল থেকে আরএসএস নিয়ে চর্চা করছি, কিন্তু এখনও হিমশৈলের চূড়াটুকুও দেখতে পাইনি। কত নামে কত রূপে যে সংগঠন ছড়িয়ে রয়েছে কত দিকে, তা আমরা বুঝতেও পারছি না। সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানো, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো, নকল ভিডিয়ো প্রচারের মতো বিষয়গুলি চলতেই থাকবে। পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওরা যে ভাবে সংবিধান দেশের ইতিহাস, দেশভাগের অপব্যাখ্যা করছে, সেটার কাউন্টার করতে হবে। যুক্তিতথ্য দিয়ে বোঝাতে হবে, এটা শুধু ধর্মের বিষয় নয়— দরিদ্রদেরও কী বিপদ আসতে চলেছে।
প্র: প্রধান নিশানা পশ্চিমবঙ্গ মনে হচ্ছে কেন?
উ: বিজেপির এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে শক্তিহীন করে দিতে পারলে বিজেপির কাজ অনেকটাই হাসিল হয়ে যাবে। তা ছাড়া সীমান্তবর্তী এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটিকে হাতে আনার জন্য বিজেপির মরিয়া চেষ্টা থাকবেই। দেখবেন আগামী দিনগুলিতে ওদের বড় বড় নেতা মন্ত্রী এবং সাধুসন্তেরা পশ্চিমবঙ্গে মিছিল করে যেতেই থাকবেন।
ইতিহাস বিভাগ, জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি
সাক্ষাৎকার: অগ্নি রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy