Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
Digital Revolution

ওদের মুখোশ খুলে দিতে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলি এখন গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্র

যে তর্জনী ঠোঁটে, তার অর্থ ত্রাসন। চুপ! কাউকে বোলো না। শেষ করে দেব! লিখেছেন তিলোত্তমা মজুমদার।

অলংকরন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অলংকরন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

তিলোত্তমা মজুমদার
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:৪৮
Share: Save:

গোপন অন্যায় প্রকাশ্যে আনা সম্ভব হলে মূলত দুটি উচ্চাঙ্গের ঘটনা ঘটে। এক, অন্যায়কারী ভয় পায় এবং নিজের নির্মোক বিষয়ে সচেতন হয়। দুই, সম্ভাব্য অন্যায়কারীরাও ভয় পায় এবং নিজের ভালমানুষি মুখোশ বিষয়ে আরও সচেতন হয়।

#মিটু’-র দৌলতে সমাজমানসের এই অনিবারণীয় দিকটি দৃশ্যমান হয়েছে।

গোপন অন্যায় অসংখ্য এবং বিচিত্র। গোয়ালা যে জলে দুধ মেশান, খেজুরিয়া খেজুর রসে চিনি গোলেন, গোপন চুক্তির মধ্যে দিয়ে মন্ত্রীরা জনগণের কোটি কোটি পরিমাণ অর্থ তছরুপ করেন, সুইস ব্যাঙ্কের গোপন তহবিল ফেঁপে ওঠে ক্রমে, তেমনই গোপনে জমি চুরি যায়, পাচার হয়ে যায় নারী ও শিশুরা। গোপনে, অতি গোপনে, ঠোঁটে বাঁ হাতের তর্জনী এবং শূন্যে ডান হাতের তর্জনী তুলে নারী শরীরে থাবা বসায় মৌন অসম্মান।

যে তর্জনী ঠোঁটে, তার অর্থ ত্রাসন। চুপ! কাউকে বোলো না। শেষ করে দেব! কিংবা, চুপ, কাউকে বোলো না, শেষ হয়ে যাবে! যে তর্জনী উঁচিয়ে আছে, সেইখানে ক্ষমতার বাস। সেইখানে তর্জন। এই ত্রাসন ও তর্জন ব্যক্তিক, একই সঙ্গে সামষ্টিক। অদ্যাবধি নারীর প্রতিটি সঞ্চলন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে, প্রকট ভাবে বা মৃদু ভাবে সমাজের সামূহিক প্রবণতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নারী যে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা, সমাজের এক পূর্ণাঙ্গ ও আত্মপ্রত্যয়ী, স্বাধিকার যুক্ত অংশ, তা বোঝে ক’জন? ক’জন মানে? ক’জন গ্রহণ করতে পারে?

নারীকে খাটো করে দেখা হয় বলেই নারীর প্রতি অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন সমাজে পৃথক ও স্বতন্ত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যান্য অপরাধ বিষয়ে সমাজে সরব প্রতিবাদ ও নিন্দা আছে, ছিল চিরকাল। শুধু ‘মেয়ে’-র বিষয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে নীরবতার ধর্ম। তোমার শরীরে কেউ অন্যায় নখর বসিয়েছে? অনধিকার চর্চা করছে কেউ? ভয় দেখিয়ে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করছে? কাউকে বোলো না। বলতে নেই। মেয়েদের অনেক কিছু সইতে হয়।

কেন? মেয়ে বলে কোন অপরাধটা শুনি? কীসের অপরাধ? খামোখা সইতে হবে কেন?

সইতে হয়। নইলে লোকে নিন্দে করে।

কী নিন্দে? কার নিন্দে?

মেয়ের! মেয়ের!

কেন? সে ভয় দেখাল, সে আদরের ছলে ছেনে দিল গা, সে অত্যাচার অসম্মান করল, তার নিন্দে না হয়ে, মেয়ের নিন্দে কেন?

তুমি নির্যাতিত, ব্যবহৃত, অপবিত্র— এ তোমারই লজ্জা!

কী অদ্ভুত নিয়ম! নিপীড়কের লজ্জা নয়, পীড়িতের লজ্জা! কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে গ্লানিবোধে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। লোকে বলে, ও কেন সাবধান হল না? ও কেন মাঝরাতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে গেল? ও কেন স্বল্প বাস পরে? আরও হাজারটি উপসর্গের খোঁজ। যদিও, সহজ সত্যটি হল বর্বরের কোনও কারণ প্রয়োজন নেই। বর্বর বলেই তার বর্বরোচিত আচরণ! মসৃণ পোশাকে তা ঢাকা থাকে। ভদ্রতার নির্মোকে ঢাকা থাকে লালসাসিক্ত মুখ। নৈপুণ্যের সঙ্গে জারি থাকে ক্ষমতার একাধিপত্য। এ সমস্তই যত গোপন থাকে, তত সুবিধা। যত ভীতি ও দুর্বলতা, তত পীড়নের প্রাবল্য!

আরও পড়ুন: পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, একলা তোমার হাতের মুঠিতে

এই প্রাচীন, জটিল এবং অর্থহীন সমাজ পরম্পরায় ‘#মিটু’ দারুণ শক্তিশালী প্রস্তর নিক্ষেপ, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না!

আর, এই সম্মিলিত প্রতিবাদ সম্ভব হত না, যদি বৈদ্যুতিন বৈঠক জমে না উঠত। বিবিধ সমাজিক মাধ্যম, যাতে যতখানি সত্য, ততখানিই মিথ্যা, যার যত বেশি আকর্ষণ ততই নিন্দা— তাকেই অবলম্বন করে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, তার ফলাফল প্রত্যক্ষ, প্রভাব সুদূরপ্রসারী! প্রথমত, এই মিথ্যে মূল্যবোধের ভিত নড়ে উঠেছে যে, কোনও মেয়ে যৌন ভাবে নির্যাতিত হলে তাকে সইতে হবে! যেহেতু যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ক্ষমতার সুবিধাভোগী দিকটি সম্পূর্ণ জড়িত এবং অবিচ্ছেদ্য, সেহেতু, এই মুহূর্তে মুখোশ খুলে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র, এই বৈদ্যুতিন সামাজিক মাধ্যমগুলি সবচেয়ে উত্তম। একে গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে পারি আমরা। যা গড়ে ওঠে কোনও স্থায়ী ব্যবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্যে, যা সম্মুখ সমর হয় অল্পই। বৃহত্তর ক্ষমতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধনীতি প্রাচীন কিন্তু চিরকালীন।

বৈদ্যুতিন বৈঠকের যে যে দিকগুলি ব্যাপক অসুবিধা ও সন্দেহের কারণ, যার মধ্যে প্রধান, পরিচয়ের গোপনীয়তা বা মিথ্যা পরিচয়— তা-ই ব্যবহার করা যেতে পারে নির্যাতনের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে। বীর মেঘনাদকেও মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে হত বই কী!

ব্যাপারটা এমন নয় যে, মুখোশ খুলে দিতে যাঁরা তৎপর, সকলেই স্বপরিচয় গোপন রাখার জন্য সচেষ্ট।

‘#মিটু’ বরং অগণিত সম্মানিত, প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিসম্পন্ন নারীর জীবনে নানা পর্যায়ে ঘটে যাওয়া যৌন অবমাননা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বপরিচয় সমেত উদ্ঘাটন করেছে।

এই উন্মোচন সারা পৃথিবীর নারীজগৎ এবং অবশিষ্ট সমাজকে বিবিধ প্রতিক্রিয়া প্রদান করেছে। আঘাত হেনেছে গোপনীয়তার মন্ত্রে, সহ্য করার শিক্ষায়, নিজ শরীর বিষয়ে অশুচিতা বোধের ভ্রান্ত ধারণায়! যেমন করে ভূমিকম্প নড়িয়ে দেয় সহস্র বছরের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির বুক এবং তা থেকে বেরিয়ে আসে গরম গলিত লাভার বিস্ফোরণ!

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, মেয়েরা বলছে, বলতে শিখছে। আরও বৃহত্তর পরিধিতে গেলে, এই অত্যাচার অনাচারের কাহিনি যার আছে, নারী বা পুরুষ বা অন্য লিঙ্গভুক্ত বা শিশু বা বালক— প্রত্যেকেই অন্যায় বিষয়ে জ্ঞাপন করার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে।

আরও পড়ুন: হাজার হাজার ভাসমান দিয়ার মতো আলোয় ভরা সম্ভাবনার নাম ফেসবুক

সবার সাহস নেই সামনে আসার। উপায় নেই। সীমাহীন অসহায়তায় আক্রান্ত থাকে জীবন। প্রচলিত যাপনের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে রাখতে পথ চলতে হয়। বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখা গ্লানি ও দুঃখের বোঝা এই পথ চলাকে কখনও দুঃসহ করে দেয়, হরণ করে ঘুম, হরণ করে হর্ষ!

সুস্মিতার কথা আমার মনে পড়ে। সে ছিল আমার বোনের মতো। সরব, সপ্রতিভ। ছাত্র রাজনীতি করত, সেই থেকে লেগেই রইল রাজনীতিতে। ছেলের দলের সঙ্গে হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াত বলে অনেকেই তাকে আড়ালে নিন্দে করত। সে পরোয়া করেনি। কিন্তু খুবই ক্ষমতাবান এক রাজনীতিকের খপ্পরে পড়ে যায় সুস্মিতা। এমনই অসম্মানজনক ভাবে ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত হল সে, যে, কাউকে এই গ্লানিবোধ ভাগ করে দিতে না পেরে, সরব হতে না পেরে, ক্ষমতাবানের ভয়ে একেবারে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। আফশোস হয়, ‘#মিটু’ ছিল না তখন। সামাজিক মাধ্যমগুলি ছিল না। শোষিত হওয়ায় লজ্জা নয়, লজ্জা প্রতিবাদহীন হওয়ায়— এই স্পষ্ট বোধের শরিক হওয়ার জন্য সহস্র কণ্ঠের সতেজ প্রেরণা সে পায়নি! পেত যদি, হয়তো মৃত্যু বেছে নিত না।

বিতর্ক আছে। সত্য ও মিথ্যার বিতর্ক। সন্দেহ আছে। আসল ও নকলের সন্দেহ। কেউ বলছেন, এই মওকায় মেয়েরা প্রতিশোধেচ্ছা চরিতার্থ করবে। নির্দোষ অভিযুক্ত হবে। চরিত্রবানেরা কলঙ্কিত হবে। হতে পারে। সম্ভাবনা আছে। আদালতে যত বিচার হয়, যত অভিযোগ ও শাস্তি— সবটাই কি নির্ভুল? বিনা দোষের অপরাধী আছে বলে আইন ও বিচার ব্যবস্থা তো তুলে দেওয়া হচ্ছে না! কিন্তু যৌন নির্যাতনের সহস্রাব্দ ব্যাপী অনুচ্চারিত ইতিহাস সমাজের দগদগে ক্ষত, এত কালের নিরাময়াতীত অসুখ— প্রকাশ যে পাচ্ছে, তাকে প্রকাশ করার জন্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের পীঠভূমি ব্যবহৃত হতে পারছে, এই দিকটি আশাব্যঞ্জক। সত্য ও মিথ্যা থেকে যতখানি সত্য ছেঁকে উঠবে, তাই দিয়েই এই রোগ অনেকখানি সারানো সম্ভব হবে।

যৌন নির্যাতনের নানান ক্ষেত্র আছে। পরিবার, আত্মীয়-বন্ধু, পথঘাটে চলতি লোকজন, আর সবচেয়ে বেশি করে কর্মক্ষেত্রে। ক্ষমতা ও স্বার্থ এখানে অঙ্গাঙ্গী হয়ে থাকে। নির্যাতন ও প্রলোভন পরস্পর দর কষাকষি করে। নিপীড়ন ও অসহায়তার নিরন্তর দ্বন্দ্ব মন ও পরিবেশ অসুস্থ করে দেয়।

দু’হাজার তেরোয় কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে দণ্ডবিধি হয়। সম্প্রতি এই অধ্যাদেশ জারি হয়েছে যে, মহিলা কর্মচারী আছেন বা মহিলারা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন, এমন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নারীসুরক্ষা বিষয়ক সমিতি তৈরি করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা যাতে সুরক্ষা ও সুবিচার পায়, তার জন্য আইনসঙ্গত বাধ্যতামূলক সামাজিক ব্যবস্থা!

এই তৎপরতার জন্য ‘#মিটু’এবং তার মাধ্যম হিসেবে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলির ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE