সকাল থেকে সন্ধ্যে ব্যস্ত কাজে। রামপুরহাটে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার...’ প্রায় শতবর্ষ আগে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ! যদিও, এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও, নারীর অধিকার বা সুরক্ষার প্রশ্নে সত্যের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ভয় পাচ্ছে বর্তমান সমাজ। কালচক্রের নিয়মে ফিরে ফিরে আসে ৮ই মার্চ, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। সেমিনার, ওয়ার্কশপ, বক্তৃতা, সম্বর্ধনায় বেশ কাটে দিনটি। তবে এটাও ঠিক, এসবের মধ্য থেকে নারী সুরক্ষায় কার্যকরী হতে পারে, এমন কিছু নতুন ভাবনাও উঠে আসে।
প্রতিদিনই শুনি, দেশের আনাচে কানাচে, শিশু থেকে বৃদ্ধা, গৃহবধূ থেকে চাকুরিরতা, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মেয়েদের ধর্ষিতা হওয়ার খবর। ধর্ষনকারীর বিভিন্নতাও লক্ষ্য করবার মতোই। এইসব অপরাধীরা, যারা বয়েসে, শিক্ষায়, পেশাগত ভাবে, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানেও ভিন্ন ভিন্ন, তারা যখন এই ঘৃণ্য কাজটি করে, তাদের মানসিকতা কি একই বিন্দুতে এসে মিলে যায়? না কি সেখানেও রকমফের ঘটে! ‘Indian Journal of Psychiatry’ তে ‘Mental health assessment of rape offenders’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে বলা হচ্ছে, ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে নারী নিগ্রহের ঘটনা ক্রমাগত উর্ধমুখী, সেখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ধর্ষক বা যৌন নিগ্রহকারীর মনের গঠন এবং মানসিক অবস্থার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। নারী নিগ্রহের পেছনে ঠিক কি ভাবনা কাজ করে, তা না জানলে সমাজ থেকে এই দুরারোগ্য ব্যাধি নির্মূল করা অসম্ভব। শুধু ধর্ষককে শাস্তি দিয়েই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মানুষের মন থেকে ধর্ষকামিতা উপড়ে ফেলার কাজটা আরও বেশী জরুরি।
মদ্যপানের সঙ্গে যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষনের সম্পর্ক নিয়েও বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে “Alcohol consumption doesn’t cause sexual assault directly, but it is one of the most important risk factors that contribute to sexual violence…, alcohol consumption is associated with aggression and loss of inhibition.” এখানে ‘loss of inhibition’ কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। মদ্যপ অবস্থায়, পাঞ্জাব পুলিশের ডিজি কেপিএস গিল কর্তৃক আইএএস অফিসার রূপান বাজাজের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই অভিযোগ ওঠার পরেও (পরবর্তীতে বিচারালয়েও তিনি দোষী প্রমাণিত হন) সেই পুলিশকর্তাকে পদ্মসম্মানে ভূষিত করা হয়! একজন উচ্চপদস্থ আমলাকে যৌন হেনস্থার বিচার পেতে যেভাবে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়তে হয়েছিলো, সেখানে একজন সাধারণ মেয়ের অবস্থা কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়! এবছরই বর্ষবরনের রাতে দত্তপুকুরে যে গনধর্ষনের ঘটনা ঘটেছিল, তাতে অভিযুক্তরা সবাই মদ্যপ ছিল বলে খবরে প্রকাশ। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায় গনধর্ষিতা ছাত্রীর গ্রামে, যেখানে মাত্র ২১০০ লোকের বাস, সেখানে বৈধ অবৈধ মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটি মদের ঠেক রয়েছে। এখন সরকারের নীতিই হল মদ বিক্রি করে কোষাগারের মেদ বৃদ্ধি। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী, খোদ কলকাতার বুকেই বর্ষবরনের রাতে অনুষ্ঠিত হয় ‘বেশরম পার্টি’। বছর শেষের ‘গণ উন্মাদনা’য় খুন, ধর্ষন, শ্লীলতাহানির ঘটনা দিনে দিনে উর্ধমুখী। এসব দেখে মনে সন্দেহ জাগে! রাষ্ট্র সত্যিই কি চায় মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হোক?
আরও পড়ুন:
ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?
নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে-গড়ছে বলিউড
এখন, স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের হাতেও অনায়াসে পৌঁছে যায় মদ এবং মাদক দ্রব্য! হাইওয়ের ধারে ধারে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ‘বার’ এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো এসব অপরাধের আঁতুড়ঘর। এ ব্যাপারে, পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারিতে যথেষ্ট খামতি রয়েছে। আজকাল, ধর্ষনে অভিযুক্ত অপ্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যাও বিপদজনক হারে বাড়ছে। সুতরাং, দরাজ হাতে আবগারী লাইসেন্স দেওয়ার আগে প্রশাসনকেও এ নিয়ে ভাবতে হবে।
ধর্ষক মানসিক অবসাদগ্রস্ত, নাকি মদ্যপায়ী, তা নিয়ে ময়নাতদন্ত চলুক। কিন্তু, মূল কারণটি হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনের গভীরে প্রথিত একটি ধারণা, যা মেয়েদের ভোগ্যবস্তু ছাড়া আর কিছু ভাবতে শেখায়নি। পুরুষতন্ত্রের সাফল্য এখানেই যে, এই ধারণাটি সে মেয়েদের মনেও চারিয়ে দিতে পেরেছে। হলিউড তারকা ডেমি মূরের বিস্ফোরক স্বীকারোক্তিটি মনে পড়ছে, যেখানে একজন মা অর্থের বিনিময়ে আত্মজাকে তুলে দিচ্ছেন কামুক পুরুষের হাতে! আমাদের দেশেও নারী পাচারকারীরা আড়কাঠি হিসেবে ব্যবহার করে পাড়ার বা গ্রামের পরিচিত মহিলাদেরই। মনে রাখতে হবে, মেয়েমানুষ হয়ে ওঠার প্রথম পাঠ কিন্তু বাড়িতেই মা, পিসিমা, ঠাকুমাদের হাত ধরে শুরু হয়। এই একবিংশ শতকেও, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে’ আপ্তবাক্যটি মেয়েদের পাখিপড়া করে শেখান হয়। এতো কিছুর পরেও, মেয়েটি যে শান্তিতে সংসার করতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই। বছর কয়েক আগে, এক প্রথম সারির বাংলা দৈনিকে পড়েছিলাম, কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায়, ততোধিক অভিজাত পরিবারের নববধূটিকে জোর করে পাঠানো হয়েছিলো পারিবারিক গুরুদেবের সেবা করবার জন্য! আবার, গৃহবধূর আপত্তির তোয়াক্কা না করে তাকে বাড়ির অন্যান্য পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে সহবাসে বাধ্য করবার মতো ঘটনাও ঘটেছে এই কলকাতা শহরেই। মেয়ে দুটি সাহস করে প্রতিবাদ করেছিল।
বাবার কাছে মেয়ে, অথবা, দাদার কাছে বোন ধর্ষিতা হচ্ছে, এসব ঘটনাও আর সেভাবে মনে দাগ কাটে না। বাড়ির ঘেরাটোপে যে সব ধর্ষন বা শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে, তা সম্মান নষ্টের ভয়ে আর অভিভাবকদের চাপে মেয়েরা গোপন রাখে। মহিলারা উপার্জনশীল হলেও, ‘মানি ম্যানেজমেন্টে’র দায়িত্ব সাধারণত পুরুষদের হাতেই থাকে। দ্বিতীয়ত, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েটির গায়ে ‘বিবাহবিচ্ছিন্না’ তকমা লাগিয়ে তার সামাজিক নিরাপত্তার জায়গাটা নড়বড়ে করে দিতে চায়।
সম্প্রতি, ‘Me Too’ আন্দোলনের দৌলতে আমরা বুঝতে পারলাম কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের এবং যৌন হেনস্থার শিকড়টি সমাজের কত গভীরে ছড়িয়েছে। কাজের জায়গায় যৌন নিগ্রহ রোধে আইন থাকলেও, তা বিশেষ কাজে আসে না। কারণ, কর্তৃপক্ষ মেয়েটির অভিযোগকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। ২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যান বলছে ভয়ে বা সামাজিক সম্মানহানির আশঙ্কায় ৭০ শতাংশ মহিলাই কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা নিয়ে অভিযোগ জানাতে চান না। পরিবারে বা কর্মস্থলে হেনস্থা হলে প্রশাসনেরও সরাসরি নজরদারি চালানোর বিশেষ সুযোগ নেই। যেখানে রক্ষকই ভক্ষক, সেখানে মেয়েরা কার কাছে যাবে সুবিচার চাইতে?
যৌন হেনস্থা এবং ধর্ষন প্রতিরোধে কড়া আইন রয়েছে দেশে। একটু খেয়াল করলে দেখব, সম্প্রতি যে ঘটনাগুলি নিয়ে দেশ তোলপাড় হয়েছে, জনমতের প্রবল চাপে তুলনামূলক ভাবে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধীদের সাজাও দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই অভিযুক্তরা অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীভুক্ত। এদেশে ধনঞ্জয়েরর ফাঁসি হয়। তেলেঙ্গানার ধর্ষকদের মৃত্যু হয় ‘এনকাউন্টারে’। নির্ভয়ার ধর্ষকদেরও হয়তো বা মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু, উচ্চকোটিতে বিচরণ করা ‘এলিট’ ধর্ষকদের চরম শাস্তির উদাহরণ একটিও আছে কি? ধর্ষন এবং খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও স্বঘোষিত ধর্মগুরু ‘রাম রহিমে’র কিংবা, উন্নাও এর ধর্ষক কুলদীপ সিংহ সেঙ্গারদের ফাঁসি হয় না! অপরাধীকে যথাযোগ্য শাস্তি দেওয়ার প্রশ্নে আড়াআড়ি বিভক্ত নাগরিক সমাজকে সুনিপুন ভাবে ব্যবহার করে রাজনীতির কারবারিরা। এসব চাপান-উতরের মাঝে পড়ে হারিয়ে যায় মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গড়ার সমস্ত দাবিপত্র। যে দেশে সরকারী আইনজীবীরা আদালতে সওয়াল করেন ‘পুরুষেরা মানবে না! মেয়েরা তাই সেনা-কর্তা নয়’ সেই সমাজে পুরুষতন্ত্রের মূলোৎপাটন করা সহজ নয়! সম্প্রতি, আদালতের একটি রায়ে মেয়েদের ‘কম্যান্ডিং অফিসারে’র পদে বসবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হল, যদিও সেনা বাহিনীর শীর্ষ পদাধিকারী হবার লড়াইটি এখনো শেষ হয়নি।
এক মহান রাজনীতিকের বাণী শুনলাম, বলেছেন, ‘When rape is inevitable, lie back and enjoy it…’। এভাবে চলতে থাকলে, সত্যিই হয়তো একদিন মেয়েরা নিজেদের শরীর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারবে না! ধর্ষনও হয়তো উপভোগ্যই হয়ে উঠবে! সেই সমাজের ছবিটা পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহকগণ ভেবে দেখবেন একটু।
লেখক বিশ্বভারতীর রসায়নের গবেষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy